মুমিন মুসলমানদের স্মরণ রাখা উচিত যে, পরম কৌশলী ও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ইহকাল ও পরকালের সফলতা চেষ্টা ও সাধনার মধ্যে নিহিত রেখেছেন। আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে : (ক) মানুষ তা-ই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা ও সাধনা করে। (সূরা নাজম : ৩৯)। (খ) (কেয়ামতের দিন) মানুষ যে সকল চেষ্টা ও সাধনা করেছে, তা স্মরণে আসবে। (সূরা নাযিয়াত : ৩৫)। (গ) যে ব্যক্তি আখেরাতের জীবনের সফলতা প্রত্যাশা করে এবং তার জন্য চেষ্টাও সাধনা করে এবং সে মুমিন, এই শ্রেণির লোকদের চেষ্টা ও পরিশ্রম গৃহীত ও মর্যাদাশীল হবে। (সূরা বাণী ইসরাঈল : ১৯)।
উল্লেখিত তিনটি আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে সত্যান্বেষী লোকদের মনের পর্দায় যে বিষয়গুলো উদ্ভাসিত হয় তা হলো, জীবন ও জগতের যাবতীয় সফলতা কামিয়াবী, উন্নতি ও অগ্রগতি চেষ্টা ও সাধনার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। এতদপ্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেন : এটি হলো অন্তর দিয়ে চেষ্টা ও সাধনা করা। আর এটি চেষ্টা ও সাধনার চারটি স্তরের মধ্যে একটি। স্তর চারটি হলো নিম্নরূপ। (১) অন্তর সহযোগে চেষ্টাও সাধনা করা। (২) রসনা ও জিহ্বা দ্বারা সাধনা করা। (৩) অর্থ সম্পদ দ্বারা চেষ্টা করা এবং (৪) সমগ্র শরীর দ্বারা পরিশ্রম করা।
এ প্রসঙ্গে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা অবিশ্বাসী অংশীবাদীদের সাথে জিহ্বা, অন্তর এবং অর্থ সম্পদ দ্বারা চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম করো।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২৫০৪; সুনানে নাসাঈ : ৬/৭)। এই হাদীসটির মর্ম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন : শারীরিক অধিক আমলের উপরেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে না। বরং তা নির্ভর করে আল্লাহ পাকের জন্য খাঁটি ও বিশুদ্ধ নিয়ত এবং সুন্নাত বা হাদীসের সঠিক অনুবর্তিতার মাধ্যমে এবং অন্তর সম্পর্কে অধিক সজাগ ও অধিক পরিচয় লাভেল মাধ্যমে এবং তা কার্যত : বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
সুতরাং এর দ্বারা স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে, চেষ্টা, সাধনা, পরিশ্রম, রিয়াজত, সোজাহাদাই হলো সফলতা লাভের চাবিকাঠি। এটা হলো আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি যাকে চান তা দান করেন। কেন না, আল্লাহ পাকের নৈকট্য, তাঁর দিকে অগ্রবর্তিতা, সুদৃঢ় ইচ্ছা, অভিপ্রায়, খাঁটি আগ্রহ এবং চূড়ান্ত সংকল্প দ্বারাই সম্ভব। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওজরের কারণে আসলে পশ্চাদ গানীতা দেখা দেয়া অসম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে মুমিন মুসলমানদের অন্তরের পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, তাকওয়া ও পরহেযগারী সহযোগে সে চেষ্টা ও সাধনা এগিয়ে চলে তাই হলো মূল বিষয়। বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তাকওয়া বা পরহেযগারী প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। মহান রুব্বুল ইজ্জত আল্লাহপাক কুরবানীর পশু এবং হজ্জ আদায়কালে ‘হাদী’ অর্থাৎ কুরবানী করা সম্পর্কে যা নির্দেশ প্রদান করেছেন, তা এ বিষয়ের প্রমাণ হয়ে আছে।
আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহর কাছে কুরবানীর পশুর গোশ্ত এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের (অন্তরের) তাকওয়া। (সূরা হাজ্জ : ৩৭)। এতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, আল্লাহপাকের কাছে অন্তরের তাকওয়া ও পরহেযগারীই পৌঁছে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়টিকে আরো সহজতর করে বিশ্লেষণ করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : তাঁরই (আল্লাহর) দিকে পবিত্র বাণীসমূহ উর্ধারোহণ করে এবং নেক আমল একে সমুচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে। (সূরা ফাতির : ১০)।
সুতরাং এ সকল বাণীর মূল মর্ম হচ্ছে এই যে, মুমিন মুসলমানের যাবতীয় আমল, চেষ্টা ও সাধনার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহ ভীতি, তাকওয়া ও পরহেযগকরী। এবং তা সম্ভব হবে আল্লাহর ভালোবাসা মহব্বত এবং মর্যাদা ও সম্মানের সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য অন্তরের ইবাদত ও বন্দেগির মাধ্যমে। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে ইবাদত, আমল চেষ্টা, সাধনার প্রকাশ্য আকৃতির কোনো মর্যাদা নেই।
বরং তা মর্যাদাশীল হওয়ার জন্য ঈমান ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল। যাতে আল কোরআন ও সুন্নাত-এর পরিপূর্ণ দিক নির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটে থাকে। তবে, যে চেষ্টা ও সাধনায় এই লক্ষ্য মাত্রার ছোঁয়াচ পাওয়া যায় না বা নেই, তার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির আশা পোষণ করা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। আল কোরআনের দিক নির্দেশনা এটাই। ইরশাদ হয়েছে : যে দিন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। সেদিন উপকৃত হবে শুধুমাত্র সে ব্যক্তি, যে বিশুদ্ধ অন্তঃকরন নিয়ে আল্লাহ পাকের নিকটে উপস্থিত হবে। (সূরা শোয়ারা : ৮৮-৮৯)।
Discussion about this post