মাসুদ আলম, আবুধাবি : আবুধাবির মুসাফ্ফা শিল্প এলাকায় একটি বাংলাদেশী রেস্তোরাঁয় আজ দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলাম আমরা ৩ বাংলাদেশী। আবুধাবি শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে সেখানে যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য- ঐ রেস্তোরাঁর ছাগলের গোস্তের বিরিয়ানিটা আমার খুব পছন্দ। একই মানের বিরিয়ানি পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয়ও পাওয়া কিন্তু আমি সময় পেলে ওখানেই যাই।
অত্যান্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দ্বিতল দোকান, উপর তলায় টয়লেট ও বেসিন এক পাশে আর অন্য পাশে ২০/২৫ জন বসার মতো পারিবারিকভাবে বসার ব্যবস্থা আর নিচে স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়াল দেয়া ও দরজা বিশিষ্ট রান্নাঘর।
সাদা পোষাক পরিহিত পরিপাটি ৮/১০ জন কর্মী মাথায় পাতলা জালি কাগজের একবার ব্যবহার যোগ্য টুপি পরা, বিভন্ন কাজে ব্যস্ত।শেষ দুপুরে আমরা ৩জনই কাস্টমার, সময় প্রায় দুপুর ২:১৫। ২জন হাত ধুয়ে নিচে বসে পড়েছে আমি উপরে টয়লেটে গিয়েছি। টিস্যু কাগজ ফেলার প্লাস্টিক ঝুড়িটি উপচে কয়েকটি নিচে পড়ে আছে। তাছাড়া সব কিছু খুবই পরিষ্কার।
আমাদের খাওয়া চলছে। বিকেলের নাস্তা- সিঙ্গাড়া, পিয়াজু, ছোলা ইত্যাদি গরম গরম তৈরি হচ্ছে আর আমাদের এক পাশের টেবিলে স্টেইনলেস স্টিলের ট্রে তে এনে রাখছে।
এমন সময় একজন স্থানীয় আরব ভদ্রলোক (সাদা কান্দুরা পরিহিত) রেস্তোরাঁয় ঢুকে ব্যবস্থাপককে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ফি হাম্মাম? (টয়লেট আছে?)
ফি, ফউক (আছে উপরে)
ভদ্রলোক হনহন করে উপরে চলে গেলেন। পাঁচ মিনিট পর মোবাইল টিপতে টিপতে নিচে নেমে এলেন এবং সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। ভিডিও করা শুরু করলেন!
কারো আর বুঝতে বাকি নেই যে উনি বলদিয়ার (ফুড সেফটি অথরিটি বিভাগের) লোক! ১৫/২০ সেকেন্ড ভিডিও করার পর অনেক গুলো ছবি তুললেন। বের হয়ে এসে ব্যবস্থাপককে নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন এবং ছবি দেখাচ্ছেন- সু হাযা? সু হাযা? সু হাযা? এটা/ এসব কি?
টয়লেটের মেঝে পড়ে থাকা টিস্যু কাগজ, একেবারে খালি তরল সাবানের বোতল, রান্না ঘরের মেঝেতে একটি জীবন্ত তেলাপোকা, একজন মাছ/মাংস ধোয়ায় ব্যাস্ত প্লাস্টিকের গ্লাভস ছাড়া খালি হাতে! তেলাপোকার “সাইজ”এ আবুধাবির চেয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে! বাংলাদেশের একটি তেলাপোকা এদেশের প্রায় পঞ্চাশটির সমান!
বাংলাদেশী ব্যবস্থাপকের তেলাপোকা রংয়ের কলিজা শুকিয়ে গেল! ব্যবস্থাপক তার সকল বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা এমনকি তার দাদার জীবন থেকে অভিজ্ঞতা ধার করে নানান বাহানা খুঁজে খুঁজে বের করে তেলাপোকার বর্ণানা করে চলেছেন!
আরবী রান্নাঘরের সামনে এসে বললেন- কুল্লি সাক্কার! (সব বন্ধ কর), সব বের হয়ে আয়! গ্যাসের চুলা বন্ধ কর, পানি বন্ধ কর, বিদ্যুৎ বন্ধ কর, খাবার পরিবেশন বন্ধ কর! রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হবে! সবাই সুর সুর করে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। আরবি আমাদের খাওয়া দাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলেন- খাওয়া শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে! তারপর আমাদের পাশের টেবিলে বসলেন।
বসে আবারো ছবি তোলা শুরু করলেন- স্টিলের ট্রে তে রাখা সিঙ্গাড়ার উপর স্বচ্ছ প্লাস্টিক বা কাঁচের ঢাকনা নাই কেন?
ব্যবস্থাপক ঘেমে অস্থির, মৃদু ভাষায় গালিগালাজ করে চলেছেন! তার অবস্থা প্রেমিকার বড় ভাইয়ের দৌড়ানি খাওয়া প্রেমিকের মতো, হাঁপাচ্ছে আর গালিগালাজ করছে! ব্যবস্থাপক অন্যদিকে তাকিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে অনুরোধ করে বলছেন- আপনারা একটু সময় লাগায়া ধীরে ধীরে খান্!
এরপর ফোন করলেন তার আরবাব কে, আরবাব হল- দোকানের বা ভবনের স্থানীয় আরব মালিক। ফোন এনে এগিয়ে দিলেন আরবির দিকে-
মুদির, আরবাব মাল আনা!( কর্মকর্তা/অফিসার…আমার আরবার আছে ফোন!)
মুদির বললেন- খাল্লি! (বাদ দে), মাই রিদ…(দরকার নাই/ কথা বলবো না!)
তিনি কোন ভাবেই এবং কারো সাথেই কথা বলবেন না সেটা তর্জনী উঁচিয়ে দৃঢ়ভাবে বলে দিলেন! এক থালা বিরিয়ানি খেতে খেতে আর কতক্ষণ সময় কাটানো যায়! খাওয়া শেষ হলো। মূল্য পরিশোধ করে দরোজার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ব্যবস্থাপক অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললেন, মুদির-এবারের মতো মুখালফা (জরিমানা) দিয়ে একটা সুযোগ দাও!
এবার উঠে দাড়িয়ে বললেন ফায়ার এক্সটিংগুইসার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) কই? বিভিন্ন প্রান্তে রাখা সবগুলোর মেয়াদ তারিখ দেখলেন, পানির শীতলকরণ যন্ত্রের ছাঁকনি দেখলেন! (সন্তুষ্ট হলেন)
এবার বললেন মেঝ মোছার সরঞ্জাম (ঝাড়ু, তরল রাসায়নিক, বিশেষ বালতি ইত্যাদি) দেখাও! দেখালানে। বললেন ওকে, হাদা জেইন ( এগুলো ঠিক আছে, ভালো)
এবার ব্যবস্থাপক বললেন, মুদির আমাদের আগে আর কখনো মুখালফা দিতে হয়নি! আমরা খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! সুতরাং একটা সুযোগ দেও! এবার একটু নরম হয়ে বললেন, আকিদ! (ঠিক বলতেছো তো!) না’আম, না’আম….(হ্যাঁ)
কাউকে ফোন করে রেস্তোরাঁর নিবন্ধন নম্বর বললেন, এবং কয়েক সেকেন্ড পর ফোন রেখে বললেন-ঠিক আছে একটা সুযোগ দিচ্ছি! মুখালফা দিচ্ছিও না। কিন্তু এই মুহুর্তে সব মালামাল বের করে পেস্ট কন্ট্রোল ডেকে পরিষ্কার করতে হবে! মালামাল বের করে ছবি তুলবা, দোকানের ভিতরের ছবি তুলবা, পেস্ট কন্ট্রোলের ছবি তুলবা! কতক্ষণ লাগবে? তিন ঘন্টা।
ওকে, আমি ছয় ঘন্টা সময় দিচ্ছি। রাতের বেঁচাকেনা শেষে শুরু করবা! আমি সকালে আটটায় আসবো! একটা কাগজ লিখে দিয়ে বের হয়ে গেলেন….
Discussion about this post