মুহাম্মাদ ইছমাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত:
বাবা কাঁদিস না । মা একটু পরই তোর কাছে চলে আসবো। কান্নার আবেগ ভরা কথার আওয়াজ কানে আসায় মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পাশের লাইনে দাড়িয়ে আমিরাত গমনেচ্ছু এক মা তার শিশু সন্তানের সাথে কথা বলছে । তাঁর কথা বলার দৃশ্য দেখে সত্যিই নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। কারণ ঠিক একই সময়ে ভাগ্য বিড়ম্বনায় আমিও সন্তান রেখে দেশান্তরি হচ্ছি। এমন সময়ে আমাকে ডাক দিয়ে চট্রগ্রাম বিমান বন্দরে কর্তব্যরত ইমিগ্রেশন পুলিশ অফিসার বললেন আপনি ৩০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? জবাবে আমি বললাম আপনি বিরতিতে যাওয়ার আগেতো এই লাইনে দাড়াতে বললেন, তাই বাধ্য হয়ে এখনো সিরিয়ালে দাড়িয়ে আছি। এভাবে প্রতিদিন বিদেশ গমনেচ্ছু অনকে যাত্রী ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থাকেন দেশ ত্যাগের আগ মুহুর্ত এমন কি বিমানে উঠা পর্যন্ত। যা একজন প্রবাসীর জন্য বেদনাদায়ক ।
দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, জীবন-জীবিকার সন্ধানে স্বদেশ ছেড়ে স্বপ্নের জীবন সাজাতে বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাস করছেন প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি। যারা মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন, গ্রাম-শহর ছেড়ে জীবন-যৌবনের স্বাদ-আহ্লাদকে ঘামের সাথে মুছে ফেলে বিদেশ পাড়ি জমান। যাদের রক্ত-ঘামে সচল থাকছে দেশের অর্থনীতি। তাদের দেশ ত্যাগ কতটা কষ্টকর কেবল মাত্র ভুক্তভোগীরা ভালো বলতে পারে ।
প্রিয়জনের সান্নিধ্য বা প্রিয়জনের সাথে কিছুটা ভালো সময় কাটানোর জন্য প্রবাসীরা নিজ দেশে ছুটে আসেন ১ থেকে ৬ মাসের জন্য। ৬ মাস ছুটি কাটান সৌদি আরব ও ইউরোপ আমেরিকা প্রবাসীরা। আমিরাত প্রবাসীদের বেলায়ও একই পদ্ধতি। যে যতদিন থাকেন না কেন বেশিসংখ্যক প্রবাসী দেশে যান ২ থেকে ৫ বছর পর। অনেক দিন প্রবাসে অবস্থানের ফলে দেশে এসে স্বজনদের সাথে কিছুদিন থাকার পর মন যখন ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে উঠে তখনই নির্ধারিত ছুটি শেষ হয়ে বিদায়ের ঘন্টা মনে নাড়া দেয়, যার ফলে দু:খ ভরাক্রান্ত মন নিয়ে একজন প্রবাসী দেশ ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়, কারণ একজন প্রবাসী নিজের সুখের চাইতে পরিবারের সুখকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে ।
স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট প্রতিটি প্রবাসীর মনে আঘাত করে যার ফলে দেশ ত্যাগের ২ দিন আগে থেকে প্রবাসীর মন খারাপ থাকে। মন খারাপ নিয়ে যখন দেশ ত্যাগের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতার জন্য বিমান বন্দরে যায় তখন প্রবাসীদের সাথে চলে নানা রকমের নাটকীয়তা। এমনিতে বিমান বন্দরের নির্দিষ্ট সীমানার বাহিরে রেখে আসা আত্নীয় স্বজনদের থেকে বিদায় দিয়ে দু:খ ভরা মন। এই উদাসীন মন নিয়ে বিমান বন্দরে প্রবেশের পরে কেমন আচরন হবে সেই ভয়ে মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। কাগজে কলমের সোনার সন্তানরা কিভাবে এই বিমান বন্দরের কার্যক্রম শেষ করবে? স্বজন ত্যাগের দু:খ ভুলে গিয়ে কত তাড়াতাড়ি বিমানে উঠবে সে উৎকন্ঠায় থাকে প্রবাসীরা।
প্রথমে গেটে ঢুকতে লাইন, লাইনে দাঁড় করিয়ে পাসপোর্ট আর টিকেট চেক করেন কর্তাবাবু’রা, এরপর স্ক্যনিং মেশিনে এক দিকে মানুষ অন্যদিকে পন্য সামগ্রী স্ক্যান চলে। পন্য সামগ্রী স্ক্যান করার পর কেন দেশ থেকে গোস্ত নিয়ে যান, এত গোস্ত কেন? মিষ্টি নিতে হয় নাকি? ঐখানে কি মিষ্টি নাই ইত্যাদি বলে অবশেষে ব্যাগেজে সিকিউরিটি চেক স্টিকার লাগিয়ে দেন ।
৩য় দফায় বোর্ডিং পাশ সংগ্রহের লাইন, গত বছর ২০১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দীর্ঘ দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বোর্ডিং পাশ সংগ্রহ করেছিলাম। বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করার পর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য চট্রগ্রাম বিমানবন্দরের নিচতলা থেকে ২য় তলায় উঠে আবার যথারীতি লাইনে দাঁড়াতে হয় । লাইনে দাঁড়ানোর আগে লিফটের মাথায় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার বোর্ডিং পাস আর পাসপোর্ট চেক করে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের লাইনে দাঁড়াতে বলেন । ভাগ্য খারাপ হলে এখানেও কম করে হলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়াতে হবে। আবার বাপদাদার আমলের মত, হাতে লিখা Departure card , কার্ড না থাকলে কার্ড লিখার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসার আবারো লাইনের বাহিরে পাঠিয়ে কার্ড লিখে নিয়ে আসতে বলেন । এক্ষেত্রে বিমানবন্দরের ভিতরে কাজ করা কিছু দালালের পকেট ভারী হয়, কলমের জন্য টাকা, ফরম লিখার জন্য টাকা! এক দালাল রসিকতায় বলেছিল অনেত্তুন ১ হাজার টিয়া নিমুনি ৩/৪শ টেয়া দিলে চলইবো। দেশ ডিজিটাল হয়েছে অথচ হাতের লিখা ফরমের কি কাজ তা বুঝে আসে না। ৫ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাস্ততম বিমানবন্দরের তালিকায় শীর্ষে থাকা দুবাই বিমানবন্দরে কোন সময়ে হাতে লিখা এমন কার্ডের কার্যক্রম চোখে পড়েনি ।
ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের শেষ হলে আবারো লাইন। ২য় বারের মত স্ক্যানারে চেক। একদিকে যাত্রী, অন্যদিকে যাত্রীর সাথে থাকা পন্য, হ্যন্ড ব্যাগেজ স্ক্যান করা হয়। স্ক্যানারের গ্রীন সিগনালে যাত্রী অতিক্রম করলেও চেকিং এর দায়িত্বে থাকা অফিসাররা যাত্রীদের উপর নীচ কোন কিছু বাদ দেন না। বিভিন্ন রকমের প্রশ্নের পাশাপাশি অনেক সহজ সরল প্রবাসীর নিকট থেকে টাকা হাঁতিয়ে নিতেও দেখা যায়। কিছু অফিসার বলেন, এতটাকা নিয়ে বিদেশ কেন যাচ্ছেন, এতটাকা নিতে পারবেন না। পরবর্তীতে স্যার নামীয় অন্যলোকের মধ্যস্থতায় কিছু টাকা দিয়ে প্রবাসী পার পায়। অবশেষে বোর্ডিং পাসের পিছেনে সিকিউরিটি চেক সিল লাগিয়ে রেস্ট রুমের পথ দেখিয়ে দেন দেশান্তরী হওয়া এ সকল মানুষকে ।
২ বার চেকিং বা স্ক্যান করার যোক্তিকতা কি? বিমান বন্দরের দ্বায়িত্বে থাকা অফিসার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ভালো বলতে পারবেন । কারণ যে ক্ষেত্রে বিমান বন্দরে প্রবেশের সময় স্ক্যান ও চেক করে সিকিউরিটি স্টিকার লাগিয়ে ভিতরে প্রবেশ করানো হয় সে ক্ষেত্রে ২য় বার স্ক্যান করার মানে কি ১ম বারের স্ক্যান ভুল! অথবা এ কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তিরা কোন দুর্নীতিতে জড়িত! নাকি তারা এ কাজের অযোগ্য! একই কাজ দুইবার করে সরকারী খরচ বাড়ানোর মানে কি!
বিশ্রাম কক্ষে গিয়ে আর বিশ্রাম নেয়ার সময় কই, বিশ্রাম কক্ষে ঢুকে শেষ বারের মতো স্বজনদের থেকে বিদায় নিতে মোবাইলে কল দিয়ে শেষবারের আলাপ সেরে নেয় প্রবাসীরা। কিছুক্ষণ পরে সিরিয়াল ধরার ডাক দিয়ে দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার বলেন, আপনারা যারা বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করেছেন তারা আবার রুমের বাহিরে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান। পুরো এক ফ্লাইটের যাত্রীকে বিশ্রাম কক্ষ থেকে বাহিরে নিয়ে গিয়ে আবারো দাঁড় করে রাখা হয় ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট । বোর্ডিং পাস চেক করে ২ অংশের ১ অংশ যাত্রীকে দিয়ে আরেক অংশ নিজদের কাছে রেখে অন বোর্ডের যাত্রী নিশ্চিত করেন।
অন বোর্ডে যাত্রী নিশ্চিত হওয়ার পর এবার বিমানে উঠার পালা। কার আগে কে উঠবে এ নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগীতা। কিন্তু এখানেও অভাগা প্রবাসীর কপালের দুর্ভোগ লেগে থাকে। দেশ ত্যাগের সর্বশেষ মুহুর্তে বিমানে উঠার জন্য এয়ারপোর্টের রানওয়েতে দিনের বেলায় প্রখর রৌদ্রের মাঝে যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াও অনেকভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয় মধ্যপ্রাচ্য আগত নির্মান শ্রমিকরা। কারণ এদের বেশির ভাগই কম শিক্ষিত বা নিজের অধিকার সম্পর্কে কিছু জানেন না। সব কিছু ঠিক থাকার পরও সন্দেহ আছে বলে আটকিয়ে দেয়া হয়, ডাকাতের চাইতেও ভয়ংকর হয় আইনের পোশাকে থাকা এসব অফিসারেরা। তাদের লজ্জা না লাগলেও তাদের আচারনের যাত্রীরা লজ্জিত হয়। অবশেষে নিজের পকেটে থাকা বাংলাদেশী টাকা আর চোখের পানির বিনিময়ে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত হন প্রবাসীরা।
আমি একজন প্রবাসী, দেশ ত্যাগের কষ্ট আমি বুঝি। স্বজনদের ত্যাগ বিচ্ছেদে আমাদের অন্তরাত্মা কাঁদলেও দেশ ত্যাগের সময় বিমানবন্দরের হয়রানির কারণে সব ভুলে যাই। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিমানবন্দরের সিস্টেম আরো উন্নত করার পাশাপাশি অসাধু আর দুর্নীতিগ্রস্থ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বিমানবন্দরে আইনি সহায়তা দিতে কার্যকরী প্রবাসীকল্যান ডেক্স চালু করা জরুরি। স্বজনদের ভালোবাসা ছেড়ে প্রবাসী হওয়া মানুষ গুলো যেন শান্তিতে দেশ ত্যাগ করতে পারে সে পরিবেশ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সঠিক ব্যবস্থা নিবেন এই প্রত্যাশা ।
Discussion about this post