যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগের চাপে রয়েছেন। লন্ডনে সাত লাখ ইউরোর এক ফ্ল্যাট উপহার পাওয়া নিয়ে মিথ্যাচার সামনে আসায় তার পদত্যাগের দাবি উঠল।
দ্য মেইল অন সানডে এক প্রতিবেদনে জানায়, টিউলিপ দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট তার খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছ থেকে পান। তবে ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা তিনি এর আগে অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে, ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপহার পাওয়া ফ্ল্যাটের বিষয়ে সরকারের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন টিউলিপ। এর ফলে বৃটেনের অর্থমন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বিভাগের দায়িত্ব থেকে তার পদত্যাগের দাবি তুলেছে বিরোধী দলের এমপিরা। এর আগে মেইল অন সানডে নামের একটি পত্রিকা বারবার টিউলিপকে প্রশ্ন করেছে তিনি দুই শয়নকক্ষের ফ্ল্যাটটি উপহার পেয়েছেন কি না। এছাড়া ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের ফ্ল্যাটটির মালিক টিউলিপের স্বৈরশাসক খালার ঘনিষ্ঠ ডেভেলপারের মালিকানাধীন কি না সে বিষয়েও তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে তিনি বারবার অস্বীকার করে এসেছেন। টিউলিপ বলেছেন যে, এটি কোনো উপহার নয়। তার দাবি ছিল তার বাবা-মা ওই ফ্ল্যাটটি তার জন্য কিনেছিলেন। এছাড়া গণমাধ্যমটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন টিউলিপ।
দ্য মেইল অন সানডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবার পার্টির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে- কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাটটি আব্দুল মোতালিফ নামের ডেভেলপারের কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন টিউলিপ। ওই ডেভেলপার হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলেও একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। টিউলিপ গণমাধ্যমে জোর দিয়ে বলেন তার বাবা-মা তার জন্য ফ্ল্যাটটি কেনেন। ভিন্ন তথ্য দেওয়ায় তিনি তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেন। লেবার পার্টির একাধিক সূত্রের বরাতে মেইল অন সানডে নিশ্চিত হয়েছে, লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার ফ্ল্যাটটি আসলে একজন ডেভেলপার টিউলিপ সিদ্দিককে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দিয়েছিলেন। টিউলিপ যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।
এদিকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশে টিউলিপের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ও তার পরিবারের আরও চার সদস্য বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরো আত্মসাৎ করেছেন। কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা দাবি করছেন, টিউলিপ যদি তার কর্মকাÐের ব্যাখ্যা না দেন, তবে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। হ্যারো ইস্টের টরি এমপি বব বø্যাকম্যান বলেন, টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তি লেনদেনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে এবং মূলত কী বলা হয়েছিল এবং কেন, তা ব্যাখ্যা করতে হবে। যদি তিনি তা না করেন, তবে মন্ত্রী হিসেবে তার আর টিকে থাকা সম্ভব নয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছায়ামন্ত্রী ম্যাট ভাইকার্স বলেন, সরকারের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য। তবে এটি আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন তিনি স্টারমারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী। হান্টিংডনের টরি এমপি নেন ওবেজ-জেকটি বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে এই নতুন তথ্য উদ্বেগজনক। এখন এটি প্রমাণিত হয়েছে যে ফ্ল্যাটটি তিনি নিজে কেনেন নি, বরং তাকে উপহার দেওয়া হয়েছে, তার আরও প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রয়োজন।
ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বৃটেনের দুর্নীতি দমন কমিশনের আর্থিক বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক। তাকে সহ তার পরিবারের অন্য চার সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের তদন্ত করছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন। এদিকে টিউলেপের বিরুদ্ধে এমন বিতর্ক ওঠায় তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন বৃটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী শিবিরের এমপিরা। গত রাতে কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা বলেছেন, ফ্ল্যাটের বিষয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে তিনি (টিউলিপ) যেন ট্রেজারি মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। হ্যারো ইস্টের কনজারভেটিভ এমপি বব বø্যাকম্যান বলেন, টিউলিপের নিজ সম্পত্তি সংক্রান্ত অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত। মূলত কি হয়েছিল তা স্পষ্ট করারও আহŸান জানিয়েছেন ওই এমপি। তিনি বলেন, যদি তিনি ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তিনি মন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য।
টিউলিপের বিরুদ্ধে চলমান বিতর্কটি উদ্বেজনক উল্লেখ করে হান্টিংডনের কনজারভেটিভ এমপি বেন ওবেশ-জেক্টি বলেন, এখন যখন জানা গেল ওই ফ্ল্যাট কেনা হয়নি বরং উপহার হিসেবে পেয়েছেন; টিউলিপকে আরও বেশি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
মেইল অন সানডে’কে লেবার পার্টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, এর আগে ২০২২ সালে যখন টিউলিপ এবং তার পরিবারের কাছে ফ্ল্যাটটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তখন তারা জানিয়েছিলেন সেটি ক্রয় করা হয়েছে। তবে গত সপ্তাহ থেকে পরিববার তাদের কথা পাল্টাতে শুরু করেছে। গত শনিবার লেবার পার্টির এক ঘনিষ্ঠ সূত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, জীবনের কঠিন মুহূর্ত পার করার সময় একজনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন টিউলিপের পরিবার। যার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ টিউলিপকে ওই ফ্ল্যাটটি উপহার হিসেবে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। একাধিক প্রতিবেদনে ওই ফ্ল্যাট দাতার নাম আব্দুল মোতালিফ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই মেইল অন সানডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন লেবার পার্টির একাধিক ব্যক্তি। তারা বলেন, দুই বছর আগে যখন টিউলিপকে ওই ফ্ল্যাটের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন যে তারা সঠিক ছিল সে তথ্য যেন প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি টিউলিপ সিদ্দিক। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, কীভাবে সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন তা নিয়ে আগের মন্তব্য থেকে সরে এসেছেন টিউলিপ।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, টিউলিপ যখন ভুল বুঝতে পেরেছেন তখনই যে সাংবাদিকরা তাকে ওই ফ্ল্যাটের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন তাদের সঠিক তথ্য পাওয়ার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন।
বৃটেনের ভ‚মি নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ সালের নভেম্বরে কিংস ক্রসের একটি ভবনে তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা পান টিউলিপ। সেসময় তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে সবেমাত্র এমএ শেষ করেছেন। এছাড়া সেসময় টিউলিপের কোনো জ্ঞাত আয়ও ছিল না। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে তিনি ওই ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেননি। তার কাছে শুধুমাত্র মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে।
গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০১ সালে ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে ওই ফ্ল্যাট কিনেছিলেন আব্দুল মোতালিফ। এর পরের বছর এপ্রিল মাসে টিউলিপের কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি কীভাবে ওই ফ্ল্যাট পেয়েছেন। তখন লেবার পার্টির পক্ষ থেকে ইমেইলে দেয়া জবাবে বলা হয়, ২০ বছর আগে টিউলিপের বাবা-মায়ের যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন তারা তাদের পারিবারিক বাড়ি বিক্রি করে দেন। সেই অর্থ দিয়েই কিংস ক্রস এলাকায় তাকে ফ্ল্যাট কিনে দেয়া হয়। এই অর্থ অন্য কোনো উৎস থেকে এসেছে এমন কোনো ইঙ্গিত সম্পূর্ণ ভুল এবং মানহানিকর। টিউলিপের পারিবারিক বাড়ি বিক্রি করার দাবির বিষয়টি নিয়েও তখন অনুসন্ধান চালায় মেইল অন সানডে। তারা জানতে পারে, ২০০২ সাল বা এর আগে টিউলিপের পরিবার কোনো বাড়ি বিক্রি করেনি। এরপর জুলাই মাসে আবারও টিউলিপ ও লেবার পার্টিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে, তিনি আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন।
টিউলিপের পার্লামেন্টারি অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো এক ইমেইল জবাবে বলা হয়, যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা ভুল এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব তথ্য কোনো লেখায় প্রকাশ করার পরিকল্পনা করা হলে টিউলিপ আইনি পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবেন না। আরও বলা হয়, যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, টিউলিপের বাবা-মায়ের পরিবারের বাড়ি বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে ওই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। টিউলিপ এই কথা বলার পর তখন আর প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি মেইল অন সানডে।
টিউলিপকে ফ্ল্যাট দেয়া আব্দুল মোতালিফ আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ সমর্থক। বাংলাদেশে এই দলটি দমনমূলক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। যার নেতৃত্বে রয়েছেন টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা। গত আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। মন্তব্যের জন্য হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি গণমাধ্যমটি।
Discussion about this post