দৃষ্টিশক্তি আমাদের জীবনে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সবচেয়ে বড় নেয়ামতগুলোর একটি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তি মাত্রই অনুভব করতে পারে দৃষ্টিশক্তি কী জিনিস। দৃষ্টিহীন দুনিয়ার কোনো সৌন্দর্য আলো-বাতাস দেখতে পারে না। তাই আমরা যারা দৃষ্টি সম্পন্ন, তাদের উচিত প্রতিনিয়ত আল্লাহ প্রদত্ত এই নেয়ামতের মূল্যায়ন করা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দৃষ্টিশক্তির যথাযথ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সূরা আন নুর: ৩০)
আল্লাহ তায়ালা এখানে পুরুষদের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি নারীদেরও দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে।’ (সূরা আন নুর: ৩১)
চক্ষুকে বলা হয়ে থাকে মনের আয়না। মানুষ প্রথমে চোখ দিয়ে দেখে, তারপর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে। পরে তা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে কর্মে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালায়। চক্ষুর যত্রতত্র দৃষ্টিপাতে মানবহৃদয় অশান্ত-অস্থির হয়। এমনও পুরুষ আছে, যে একজন বেগানা নারীর প্রতি মাত্র একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে, যার ফলে বছরের পর বছর অন্তর্দহন ভোগ করেছে।
যেকোনো ধরনের বড় পাপে বান্দার নিমজ্জিত হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে দৃষ্টিপাত। পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, বিপণী-বিতানে বেগানা নর-নারীর ওপর ভুলক্রমে আমাদের দৃষ্টি নিপতিত হতেই পারে। পরক্ষণে সাথে সাথেই দৃষ্টি অবনমিত করতে হবে। ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিকে সেখানে প্রলম্বিত করা যাবে না। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে হযরত আলী রা: রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে আল্লাহর রাসূল বলেন, ‘হে আলী, অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি পড়ে গেলে পুনরায় তুমি দৃষ্টি দিও না। কেননা, প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য কিন্ত পুনরায় দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়।’ (তিরমিযি শরীফ-২৭৭৭)
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রতিমূহুর্তে আমাদের দৃষ্টিশক্তির খেয়ানত হচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দা খুললেই, স্মার্টফোনে, ফেসবুকে, ইউটিউবে, ইন্টারনেটে ভেসে উঠছে খোলামেলা বেপর্দা নারীর দৃশ্য। এছাড়াও বর্তমানে ব্যপকভাবে ইভটিজিং, পরকীয়া, ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণও চক্ষুর লাগামহীন যত্রতত্র ব্যবহার। দৃষ্টিশক্তির সামান্য একটু অপব্যবহারের ফলে বহু বছরের সুখীসংসারে ভাঙন ধরেছে। দৃষ্টিশক্তির খেয়ানতের আগুনে পুড়ে সংসার জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
ইবনুল কাইয়্যিম রহ: লিখেছেন, ‘দৃষ্টিই যৌন লালসা উদ্বোধক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌনাঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদস্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই তার মূল কারণ। কেননা, দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়। আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে। আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোনো বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোনো উপায় থাকে না।’ (আল-জাওয়াব আলকাফি : ২০৪)
দুনিয়ার যাবতীয় নেয়ামত উপভোগ্য হওয়ার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে চক্ষু। আমাদের দুনিয়ার জীবনকে সুখময় ও পরকালের নাজাতকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চক্ষুকে ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর ওয়াদা ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ (সূরা ইব্রাহিম আয়াত -১০)
আমরা যদি দৃষ্টিশক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করি, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে তা থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে বহুগুণ উপকৃত হওয়ার তাওফিক দেবেন। কিন্তু যদি এর অপব্যবহার করি যেকোনো সময়ে আল্লাহ তা ছিনিয়ে নিতে পারেন ।
আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখবো। চক্ষু দিয়ে আল্লাহর নিদর্শনগুলো হৃদয় থেকে পর্যবেক্ষণ করে ঈমান বৃদ্ধি করব। আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্ত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হবো। দৃষ্টি সংযত করলে ঈমান মজবুত হয়। অন্তরে ঈমানের স্বাদ লাভ হয়। চেহারায় নূর সৃষ্টি হয়। একজন বান্দা ইবাদতের প্রকৃত তৃপ্তি লাভ করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও বান্দা তার যাবতীয় জাগতিক কাজকর্মে পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করতে পারে। অনেক সময় যারা যত্রতত্র দৃষ্টিপাত করে তাদের কাজকর্মে বিপুল পরিমাণ মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটতে দেখা যায়। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। আমীন
Discussion about this post