আব্দুল্লাহ আল শাহীনঃ চতুর্দিক থেকে একই উপলব্ধি হতাশা। যুব সমাজ যেন হতাশায় নিমজ্জিত। দেশ থেকে যেসকল যুবকরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের মধ্যেও হতাশা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা বলতে না চাইলেও অর্থনীতির খারাপ সময় যাচ্ছে তা বলা যাবে। মূলত বিশ্ব ব্যাপী বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে এই হতাশা।
অর্থনীতির ভাষায় কাজ না থাকলেই কেউ বেকার বলে গণ্য হবে না। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও যখন কেউ কোনো কাজের সন্ধান পায় না তখন তাকে বেকার বলা হয়। অর্থাৎ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্ম জগতে প্রবেশ করতে না পারাই বেকার। শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব। ইদানীং শিক্ষিত বেকারত্বের হার উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে। বলা হয় যুবসমাজই দেশের আসল শক্তি। কিন্তু বেকারত্বে এই শক্তির সীমাহীন অপচয় ঘটে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য পরিকল্পিত ভাবে বেকার সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। সমাধানের জন্য শুধু যে কাজে দক্ষ হতে হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে তা নয় বরং সাথে মানসিক উন্নতির প্রয়োজন।
সে জন্য তিনটি উপায়ে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব_
(ক)বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ।
(খ) কর্মসংস্থান।
(গ) কাজের মূল্যায়ন ।
বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ :
দেশের প্রত্যেকটি জেলায় বেকারদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে হতে পারে। সেই সব কেন্দ্রে শিক্ষিত বেকারদের অর্জিত সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণের ধরণ নির্ণয় করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে । এই প্রশিক্ষণ দেশ কিংবা বিদেশে কাজের জন্য সহায়ক হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুযোগ থাকা চাই। পাশাপাশি দক্ষ মানব সম্পদ বিদেশে যেতে পারলে বৈদেশিক রেমিটেন্স বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। এখানে একটা বিষয় বলা জরুরি আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অর্থ ও মামার (শক্তি/সহযোগী) অভাবে চাকুরী হয়না। এছাড়া কিছুসংখ্যক সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায়ই বন্ধ রয়ে যায় যা দেশের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক। বেকারত্ব দূর করতে হলে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আগ্রহ জাগানোর জন্য প্রচারে গুরুত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ভাবে টেলিভিশনে ছোট ছোট নাটিকা কিংবা ব্রিফিং দেওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেও প্রশিক্ষণে আগ্রহ জাগানোর কাজ করানো যাবে। কলেজ ভার্সিতে প্রশিক্ষণ কর্মশালার ক্যাম্প বসালেও ভালো হবে।
কর্মসংস্থান :
দেশে কর্মসংস্থানের অভাবেই মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বিদেশমূখী হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পথে শত শত যুবক জীবন দিচ্ছে।ব্যাংক ঋণে মাত্রাতিরিক্ত সুদ, সার্ভিস চার্জের নামে অর্থ আদায়সহ ঋণ অনুমোদনের নামে ঘাটে ঘাটে হয়রানি, জান মালের নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা কারণে শিল্পপতিরা দেশে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এতে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। দেশে নানা কারণে একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেসকল পণ্য দেশে উৎপাদনের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে সেসব সমজাতীয় পণ্য আমদানী বন্ধ করা জরুরি। নয়তো শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতিতে আরো বিপত্তি দেখা দেবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ সাধন করা জরুরি। সে জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা সরকার কিংবা নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব। শিল্পকারখানা তৈরিতে আগ্রহীরা পুঁজির জন্য প্রথমেই ব্যাংকের কাছে যায়। বেকার সমস্যা সমাধানে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্যাংকের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সুদ বিহীন ঋণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব।
বেকারত্ব নিরসনে কুটির শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম।কুটির শিল্পে নারীদের ভূমিকা বেশি। কিন্তু বর্তমান সময়ে আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। কুটির শিল্পের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে। কুটির শিল্প মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা সম্ভব। বিশেষ করে নারীরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি কুটির শিল্পে মনযোগী হতে পারে।
আমাদের দেশে নারীদের নিরাপত্তার প্রশ্নে অনেক পিছিয়ে। নারীদের বাহিরে কাজ করা অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কাজের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেক নারী সংগ্রাম করে নিজের কর্মস্থলে টিকে আছেন। সামাজিক সচেতনতা, নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং পারিবারিক উদ্যোগে কুটির শিল্পে নারীদের আগ্রহ জাগাতে হবে। প্রবাসে নারী শ্রমিক প্রেরণের পরিবর্তে কুটির শিল্পে মনোনিবেশ করা যায় কিনা তা রাষ্ট্রের ভাবনার সময় এসেছে। নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও স্বাবলম্বী করার জন্য বেশি করে কুটির শিল্প তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
কাজের মূল্যায়ন :
দেশে শ্রমের মূল্যায়ন তেমন নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে শ্রমকে চরম অপমান করা হয়। যদিও মুখে বলা হয় কাজ কাজই, সকল কাজই সমান। কিন্তু আমাদের দেশে কাজকে ছোট বড় বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়। অথচ আমরা জানি মানুষ জীবন ধারণের জন্য যেসকল কাজ করে তাই হলো শ্রম। বেঁচে থাকার তাগিদে, পরিবারকে ভরণ-পোষণের জন্যই সবাই কাজ করে। ধনি-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নর-নারী নির্বিশেষে সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে। সেই সূত্রে পৃথিবীর সব মানুষই শ্রমিক। দিনমজুরের শ্রম, কৃষকের শ্রম, শিক্ষকের শ্রম, অফিসারের শ্রম, পিওনের শ্রম, ব্যবসায়ীর শ্রম,পাইলটের শ্রম,ডাক্তারের শ্রম,ইঞ্জিনিয়ারের শ্রম,আইনজীবীর শ্রম সবই সমান মর্যাদার অধিকারী। মুচির জুতা সেলাই , নাপিতের চুল কাটা, ধোপার কাপড় পরিষ্কার করা, ডাক্তারের চিকিৎসা, পাইলটের বিমান চালানো, রিক্সা চালকের রিক্সা চালানো সব কাজ এতই জরুরি যে, কাউকে না কাউকে এই কাজগুলো করতেই হবে।
উন্নত দেশে কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা পড়ালেখার পাশাপাশি হোটেলে কাজ করে, অফিস আদালতে পিওনের কাজ করে, কেউ কেউ আবার টেক্সি চালায়। আমাদের দেশে সেটা সম্ভবপর নয় যার একমাত্র কারণ অসম্মানের ভয়। আমাদের দেশে হোটেল বয়কে যেকেউ থাপ্পড় মেরে দেয়। অফিসের পিওনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। টেক্সি ড্রাইভারকে তুই বলে সম্বোধন করা হয়। বেকারত্ব রোধে মানসিক পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন পালন করতে পারে। সমাজের অনেক কিছুই মানসিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয়।
Discussion about this post