অন্যদিকে, প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বছরের পর বছর প্রিয়জনদের থেকে দূরে থেকে বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশ চলে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হয়, কিন্তু তারা নিজেরাই রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আমার মতো যারা চার দশক ধরে দেশের বাইরে কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং অর্জিত সবকিছু দেশে বিনিয়োগ করেছেন, তারা একটি প্রশ্ন তোলেন—‘যদি আমরা দেশে ফিরে স্থায়ী হতে চাই, রাষ্ট্র আমাদের জন্য কী ব্যবস্থা করেছে? আমাদের ভবিষ্যৎ কি সুরক্ষিত?’
এই প্রশ্ন শুধু আমার নয়, এটি কোটি প্রবাসীর মনের আর্তি। কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে?
প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছেন। তাদের পাঠানো অর্থ দেশের জিডিপির ৭-৮ শতাংশের বেশি। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, দরিদ্র পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন এবং ছোট ব্যবসার প্রসারে সরাসরি ভূমিকা রাখে। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা এই রেমিট্যান্স, যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
প্রবাসীরা তাদের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা, শোষণমূলক কাজ এবং অনিরাপদ পরিবেশে বছরের পর বছর কাটান।
অন্যদিকে দেশে যারা দুর্নীতি আর লুটপাটে মগ্ন, তারা আরামদায়ক জীবনযাপন করছেন। কিন্তু যারা দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি তৈরি করছেন, তারা রাষ্ট্রের কাছে একপ্রকার উপেক্ষিত।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জীবন শুধুই পরিশ্রম ও ত্যাগের এক কষ্টের গল্প হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের জন্য অবিরাম কাজ করেও তারা অবহেলিত থেকে যান। তাদের জন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই, অবসরকালে কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমনকি বিপদের সময় কোনো সাহায্যও নেই।
রাষ্ট্রের উচিত এই অবহেলা দূর করে প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। কারণ, তাদের শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পেছনে রয়েছে তাদের রক্ত, ঘাম এবং অগণিত স্বপ্ন।
কোটি প্রবাসী মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই আর্তি অস্বীকার করে আর কতদিন দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা দেশের সম্পদ লুটপাট করবেন?
সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কোথায়, কীভাবে এবং কখন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
তারা তো দেশের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করছেন, কিন্তু তাদের জন্য কোনো ন্যায্য ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্র তাদের অবদান স্বীকার না করে কেবল কথার ফুলঝুরি দিয়ে যাচ্ছে। এখনো রাষ্ট্র শেখ হাসিনার নীতির পথেই হাঁটছে। গরীবদের অবহেলা করে আমলাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেন?
প্রবাসীদের জন্য পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে কেন এত দেরি হচ্ছে?
একটি দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের অবদানকে উপেক্ষা করা মানে নিজেদেরই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা। প্রবাসীদের কথা না বলার মধ্য দিয়ে আমরা তাদের রক্ত, ঘাম ও ত্যাগের মূল্যায়ন না করেই এই অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অমূল্য রত্ন। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির মূল ভিত্তি। এ বৈদেশিক মুদ্রা শুধু দেশের জিডিপি বাড়াচ্ছে না; এটি গ্রামের অর্থনীতি, ছোট ব্যবসার প্রসার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তবে, এই মহামূল্যবান অবদান রাখা মানুষগুলোর জন্য অবসরের পর কোনো আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকা রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
Discussion about this post