আগামীর বাংলাদেশকে তরুণদের তুলে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছর আমরা দফায় দফায় আমরা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্ত সেই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি আমরা ঘটাতে পারিনি। স্বৈরাচারকে আমরা তাড়াতে পারিনি, বিদায় করতে পারিনি। আমি গর্বিত আমাদের সন্তানেরা সেই কাজটি করেছে। আমি আমাদের সন্তানদেরকে ভালবাসা উপহার দিলাম। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জাতির পক্ষ থেকে তাদেরকে স্যালুট জানাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে তারা অসাধ্য সাধন করেছে। এমন সন্তান পেয়ে জাতি গর্বিত। ইনশাআল্লাহ আগামীর বাংলাদেশ আমরা তাদের হাতেই তুলে দিবো।’
শনিবার সকালে মৌলভীবাজার জেলা সরকারি হাইস্কুল মাঠে জেলা শাখার উদ্যোগে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সম্মেলনে জেলা আমির মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের আমির ইঞ্জিনিয়ার মো: শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে এবং জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইয়ামির আলী ও সহকারী সেক্রেটারি হারুনুর রশিদের যৌথ পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো: ফখরুল ইসলাম ও সিলেট জেলা আমির মাওলানা হাবিুবুর রহমান।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন, হবিগঞ্জ জেলা আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মুতলিম ও মো: আবদুল মান্নান, মৌলভীবাজার বিএনপি জেলা শাখার আহ্বায়ক ফয়জুল কবির ময়ুন, হেফাজতে ইসলামীর জেলা নায়েবে আমির অধ্যাপক মাওলানা আবদুস সবুর, মৌলভীবাজার জেলার নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রহমান, ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর সভাপতি শরিফ মাহমুদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য ও পল্টন থানা আমির শাহীন আহমদ খান, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আমিনুল ইসলাম, শিবিরের মৌলভীবাজার শহর শাখার সভাপতি তারেক আজিজ, শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি হাফেজ আলম হোসাইন, বড়লেখা উপজেলার সাবেক আমির মো: কমর উদ্দিন, মৌলভীবাজার পৌর শাখার আমির ও জেলা কর্মপরিষদ সদস্য হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলা আমির মো: ফখরুল ইসলাম, বড়লেখা উপজেলার আমির মো: এমদাদুল ইসলাম, রাজনগর উপজেলার আমির আবুর রাইয়ান শাহীন, কুলাউড়া উপজেলার আমির অধ্যাপক আব্দুল মুনতাজিম, জুড়ী উপজেলার আমির আব্দুল হাই হেলাল, শ্রীমঙ্গল উপজেলার আমির মাওলানা ইসমাঈল হোসেন, কমলগঞ্জ উপজেলা আমির মো: মাসুক মিয়া।
উল্লেখ্য, এর আগে মাওলানা শেখ আব্দুল হকের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন জেলা মসাসের শিল্পীগোষ্ঠী।
ঘন কুয়াশা আর শীতের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে হাজার হাজার কর্মী সমর্থক সম্মেলনে উপস্থিত হন। মানুষের ঢলে আশপাশের রাস্তাঘাট মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে যায়। সকাল ১১টার দিকে কিছুটা রোদেও দেখা মিললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মৌলভীবাজারের আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠে।
ডা: শফিকুর রহমান বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠেন ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে। দলের আমির নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রথম নিজ জেলা মৌলভীবাজারে খোলা মাঠে কর্মী সমাবেশে ভাষণ দিলেন ডা. শফিকুর রহমান।
বক্তব্যের শুরতেই জুলাই আন্দোলনের বীর সৈনিকদের একটি গান উচ্চারণ করে বলেন, ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ তাদের ক্ষোভটা ছিল সাড়ে ১৫টা বছর। এ সময়টায় তারা জাতির ঘাড়ে বসে সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। দেশটাকে শ্মশান কিংবা গোরস্তানে পরিণত করেছিল। এরা মাঝে মাঝে বলতো দেশে নাকি অনাবিল শান্তি বিরাজ করছে। আমরা বলতাম শান্তি তোমরা কায়েম করেছ কবরের মতো। যেখান থেকে হাসি কিংবা কান্নার শব্দ শোনা যায় না। কবরস্থানে কোনো মানুষ থাকে না। হাসি কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না। ২৮ অক্টোবর তারা লাশের ওপর নর্দন করেছে। তখনই তারা জানান দিয়েছিল যে ক্ষমতায় এসে খুন-গুমের রাজ্য কায়েম করবে। আমরা সেদিন আমাদের বুকের কান্না বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়তো বা পৌঁছাতে পারিনি। এরপর পেছনে বোঝাপড়া করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং একটি জগন্য সরকারে হাত ধরে করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছিল। ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসে খুনের নেশা বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমে তারা খুন করে সেনাবাহিনীর চৌকস ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে পিলখানায়। ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি। দুই মাস না যেতেই তারা খুনের রাজত্ব কায়েম করে। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। বিডিআর বাহিনী ধ্বংস করে সেই বাহিনীর সাড়ে ১৭ হাজার সদস্যকে চাকরিচ্যুত করলো। সাড়ে আট হাজারকে জেলে দিল। জেলের ভেতর সাড়ে তিন শ’র অধিক মারা গেল। আমাদের গর্বের বাহিনী ধ্বংস হলো। ক্ষমতায় যাওয়ার শেষ সিড়ি হিসেবে এদের ব্যবহার করে চক্রান্ত করে ধ্বংস করে দিলো। বাহিনীর নাম বদলে বিজিবি রাখা হয়েছে। আগে নাম ছিল বাংলাদেশ রাইফেলস। আর এখন নাম দিয়েছে বর্ডারের চৌকিদার। লগো বদলিয়েছে, ড্রেস বদলিয়েছে। নাম বদলিয়ে ফেলেছে। কারা হত্যাকারী ছিল জাতিকে জানতে দেয়া হলো না। লুকোচুরি করা হলো। রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো কেড়ে নিয়ে, অন্ধকার করে খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো। একটা বিশেষ দেশের প্লেন কেন এসেছিল ঢাকায়। এরপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল কিভাবে। তার জবাব স্বৈরাচারী সরকাররা না দিলেও একদিন তাদেরকে দিতে হবে। আমরা ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রতিদেশী দেশকে বলতে চাই-আপনারা শান্তিতে থাকেন। আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেন। আপনাদের পাক ঘরে কী পাকাবেন আমরা জিজ্ঞেস করি না। আমাদের পাক উকি মারার চেষ্টা করবেন না। নিজেরা আয়নায় চেহারা দেখুন। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবক দিতে হবে না।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির উল্লেখ করেন, যেখানে আমাদের শীর্ষ ১১ নেতাকে খুন করা হয়েছে, সবগুলো অফিস তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, আমাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছে, বেদিশা হয়ে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয়েছে। এত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বলেছি দেশ আমরা ভালবাসি, মানুষকে আমরা ভালবাসি।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চাইলে আমরা কিছু কিছু চাঁদাবাজি করতে পারতাম। কিছু দখল নিতে পারতাম। কিন্তু এটা আমাদের জন্য হারাম মনে করি। প্রিয় বাংলাদশে গড়তে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের আরো ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারবেন? এ সময় সবাই হাত তুলে সাই দেন।
জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা একটা সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। বৈষম্যকে নির্বাসনে পাঠাবো। আমরা মেধার স্বীকৃতি প্রদান করবো, পলিটক্রেসি নয় মেরিটক্রেসির ভিত্তিতে জাতি গঠন করবো। যুবকদেরকে শিক্ষা দিয়ে বেকারের হাত বাড়াবো না, যুবকদের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করবো।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অ্যাগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কেন? মৌলভীবাজার কী অপরাধ করেছে?
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, এ জেলার কৃতি সন্তান একজন কৃতি অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি সারাদেশকে সমান চোখে দেখতেন। আগামীবার একনেকে যেন মৌলভীবাজারে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ দিয়ে অন্য কোনো উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেই দাবি জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি চা বাগান। রাষ্ট্রীয় যথাযথ পর্যবেক্ষণ না থাকায় চা শিল্প ধ্বংস হওয়ার পথে। মালিকপক্ষ চায়ের যথাযথ মূল্য পান না। শ্রমিকরাও পারিশ্রমিক পান না।
তিনি নেতাকর্মীদের চারটি বিষয় তুলে ধরেন এর মধ্যে নিয়ত সহি করে জ্ঞানের রাজ্যে এগিয়ে গিয়ে সাহসী হয়ে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান করেন। সবশেষ তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, ‘এই দেশে আর কোনো চক্রান্ত মাথা চারা দিয়ে উঠতে দেয়া হবে না। তাদের আর কোনো চক্রান্ত সফল হতে দেয়া হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নেতাকর্মীদের ঐতিহাসিক এবং ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চক্রান্তকারীদের আর সুযোগ দেয়া যাবে না।’
মুহাম্মদ সেলিম উদ্দীন বলেন, ‘ছাত্র-জনতা এই দেশের বেশিভাগ মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পেরেছিল বলেই গান তুলেছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং বিপ্লব করে স্বৈরাচার তাড়িয়েছিল। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের পুরানো ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করতে হবে। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়তে হলে মানুষের আইন দিয়ে দেশ পরিচালনা করলে চলবে না।
এর আগে, যারা দেশ শাসন করেছিল তারা মানুষের আইন দ্বারা শাসন শোষণ করে দুর্নীতিকে প্রধান হাতিয়ার করে তুলেছিল। আমরা বলতে চাই এই দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দেশের বেশিভাগ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আল্লার আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করলে এদেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গত ৫৩ বছরে দেশের মানুষের সামনে ইসলামী অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবকিছুর মডেল উপস্থাপন করেছে। আমরা বক্তৃতায় বিশ্বাসী নই। কাজে বিশ্বাসী।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে কোনো পরাশক্তি দেশের প্রতি চোখ রাঙাতে পারবে না। আর কোনো ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলবে না। সবাই স্বাধীনভাবে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে।’ ইনশাআল্লাহ।
Discussion about this post