টাকা ও ক্ষমতার জোরে কাউন্সিলর হয়েও একাধিকার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে আসাদুর রহমান কিরণ প্রায় পুরো এক মেয়াদের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।
ক্ষমতা কিরণকে বিপুল টাকার মালিক বানিয়ে দেয়। দেশ-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন তিনি।
গতকাল সোমবার রাতে যশোর জেলার বেনাপোলে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবির হাতে আটক হন আসাদুর রহমান কিরণ। তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তার বিরুদ্ধে গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গীস্থ পাগার এলাকার বাসিন্দা আসাদুর রহমান কিরণের বাবা মরহুম নূর মোহাম্মদ খান ছিলেন একটি স্কুলের দপ্তরি এবং কিরণ ছিলেন একটি কারখানার শ্রমিক। স্বৈরশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে আসাদুর রহমান খান কিরনের রাজনীতির হাতে খড়ি।
২০০০ সালে বর্তমান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান দ্বিতীয় মেয়াদে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে, কিরণ রাতারাতি আজমত উল্লাহ খানের ঘনিষ্ঠজন হয়ে যান। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি টঙ্গী পৌরসভার কমিশনার এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কমিশনার নির্বাচিত হয়েই কিরণ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
২০১৩ সালের প্রথম নির্বাচনে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মান্নান ২০১৩ সালে সাময়িক বরখাস্ত হলে আসাদুর রহমান কিরণ বিপুল টাকার বিনিময়ে প্যানেল মেয়র হয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন। ভারপ্রাপ্ত মেয়র নির্বাচিত হয়ে ২০১৫-২০১৮ মাত্র ২৭ মাসেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
কিরণ গাজীপুরের টঙ্গীতে তিনটি এবং ভালুকায় ২০০ বিঘা জমিতে ১টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন। টঙ্গী এবং উত্তরাতেও একটি বহুতল বাড়ি করে অসংখ্য জমি, ফ্লাটে বিনিয়োগ করেন। তার দায়িত্বকালীন সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন শিল্প কারখানার হোল্ডিং ট্যাক্স জালিয়াতি করে কমিয়ে এবং ঠিকাদারদের থেকে কমিশন বাণিজ্য করে বিভিন্ন সেটেলমেন্ট করে কয়েকশত কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিরণ এবং তার স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক বলে জানা গেছে।
এদিকে ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির দায়ে সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বরখাস্ত হলে কিরণ আবারো বিপুল টাকার বিনিময়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বলে জানিয়েছেন তারই ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র। কিরণের দুর্নীতির মধ্যে উত্তরায় ১১ নাম্বার সেক্টরে ৭ নাম্বার রোডে ১০ নম্বর বাড়ি (৭ তলা আলিশান ভবন বর্তমান মূল্য আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা) উত্তরায় ৭ নাম্বার সেক্টরে ১৮ নাম্বার রোডে ৯৫ নম্বর ১২ তলা ভবন (নির্মাণাধীন) আনুমানিক মুল্য ৩৫ কোটি টাকা)। রূপায়ন সিটি উত্তরায় ম্যাজিস্ট্রিক ফেইস ৮ নাম্বার বিল্ডিং এ দুটি লাক্সারিয়াস কন্ডোনিয়াম ফ্ল্যাট, যার আনুমানিক মূল্য ১৬৬০ কোটি টাকা।
এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায় নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে ২০০ বিঘা জমির ওপর ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। রাজধানীর গুলশান ২ এ ৭৯ নাম্বার রোডে ২৫০০ স্কয়ারফিটের আলিশান ফ্ল্যাট রয়েছে কিরণের। যার আনুমানিক মূল্য ১৪ কোটি টাকা। গাজীপুর সিটি করপোরেশন আওতাধীন টঙ্গী জোনে তার তিনটি ফ্যাক্টরি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। তাছাড়া টঙ্গীর পাগার, আশুলিয়া এবং গাজীপুরে তার নিজ নামে এবং স্ত্রী, শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমি রয়েছে।
টঙ্গীর পাগারে সংখ্যালঘুদের জমি ও মরকুন কবরস্থান দখলেও অভিযোগও কিরণের বিরুদ্ধে। প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দুর্নীতি করে পাচার করা টাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বাড়ি করেন। যার আনুমানিক মূল্য ৪০০ কোটি টাকা। তার নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে এবং ছেলে-মেয়ের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে বিপুল নগদ অর্থ রয়েছে কিরণের। নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক এবং শ্যালিকার নামে বিভিন্ন ব্যাংকের লকারে রক্ষিত ৫০০-৬০০ ভরি স্বর্ণ ও ডায়মন্ড রয়েছে।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন পালনের নামে কিরণ সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলর এবং কিছু কর্মকর্তাদের পিকনিক আয়োজন করার নামে করপোরেশনের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ বাবদ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
হাইকোর্টের আদেশ
গত বছরের ২০ জুলাই দুদকে জমা পড়া অভিযোগ লাল ফিতায় আটকে গেলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। গত বছর ২১ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেন। একইসঙ্গে গাজীপুরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারিও করেছিল আদালত।
এ বিষয়ে টঙ্গী ও গাজীপুর আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কিরণ ৫ আগস্টের আগে কালের কণ্ঠের এই প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তার যা সম্পদ আছে, সবই বৈধ। তার কোনো অবৈধ সম্পদ তার নেই। রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানান কিরণ।
Discussion about this post