প্রবাসী বাংলাদেশিরা সরকারের কাছে হীরার টুকরো। বর্তমান ডলার সংকটকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বিদেশে থাকা কর্মীদের প্রতি আছে সুনজর। কদর বাড়তে থাকায় দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে তাদের পাঠানো ডলারের দাম। মাঝেমধ্যেই দেওয়া হয় নানা প্রণোদনা। দেশের আমদানি খাতে মুখ্য ভূমিকা রাখায় তাদের ডাকা হয় ‘রেমিট্যান্সযোদ্ধা’। কিন্তু এই যোদ্ধারাই কর্মক্ষেত্রে মারা গেলে হয়ে যান মূল্যহীন! সাধারণত মেলে না সরকারি কোনো অনুদান, অর্থাভাবে দেশে ফেরে না লাশ। পরবাসের হিমঘরে পড়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন, সপ্তাহ এমনকি মাসও। তাদের মরদেহ মাতৃভূমিতে নিতে দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হয় স্বজনদের।
জানা গেছে, সহকর্মীদের অনুদান, চাঁদা উত্তোলন আর বিত্তবানদের সহায়তায় শেষবার দেশে ফেরা হয় অধিকাংশ প্রবাসী কর্মীর। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে মাস খানেকও সময় লাগে। এতদিন লাশগুলো পড়ে থাকে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে। বহুবার সরকারি খরচে প্রবাসীদের লাশ দেশে পাঠানোর দাবি উঠলেও কার্যত তা পূরণ হয়নি। এ কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী মোশারফ মারা যাওয়ার পর বড় বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্বজনরা। লাশটি ফেরত আনার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের কাছে না থাকায় বিদেশের মর্গে মরদেহটি পড়েছিল ২১ দিন। অবশেষে সহকর্মী ও বিত্তবানদের আর্থিক সহায়তায় গত শনিবার রাতে আবুধাবি থেকে একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরে তাঁর মরদেহ।
ভাগ্য বদলের আশায় আমিরাতে পা রেখে ৯ দিনের মাথায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মোশারফ। তিনি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বটতলা বাজারের ফকির আলীর ছেলে। একটি সেলুনের কাজে গত ২৫ জুলাই দেশটিতে পাড়ি জমান তিনি। ৩ আগস্ট দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। আমিরাতে স্বজনহীন এই প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে উদ্যোগ নেন মোহাম্মদ করিম উদ্দীন নামের আরেক প্রবাসী। অন্যদের কাছে হাত পেতে মোশারফের মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। এতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার দিরহাম, যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার নজির আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ মামুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ২২ আগস্ট আমিরাতের আল আইনের একটি হাসপাতালে মারা যান। পারিবারিক খরচে গত শুক্রবার রাতে দেশে পাঠানো হয় তার মরদেহ। দুবাই থেকে মোহাম্মদ তাজউদ্দিন নামের আরেক প্রবাসীর মরদেহ দেশে ফিরেছে গত ২২ আগস্ট। মৃত্যুর আট দিন পর সহকর্মীদের আর্থিক সহায়তায় এই প্রবাসীর মরদেহ দেশে ফেরে। আল আইন প্রবাসী মোহাম্মদ করিম উদ্দীন আক্ষেপ করে বলেন, যতদিন জীবিত আছি ততদিনই আমরা অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
রেমিট্যান্সযোদ্ধা। কাগজেকলমে কদর-সমাদর আছে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেই বোঝায় পরিণত হন প্রবাসী কর্মীরা। শেষ যাত্রায় হন চূড়ান্তভাবে অবহেলার পাত্র। পরিবার-স্বজনরা শেষবার দেখার অপেক্ষায় থাকলেও অর্থাভাবে সময় মতো পৌঁছে না মরদেহ। দিন শেষে লাশগুলো চাঁদা তুলে পাঠানো খুবই কষ্টদায়ক। অথচ, পাকিস্তানও সরকারি খরচে তাদের প্রবাসী কর্মীদের লাশ দেশে নিয়ে যায়।
দুবাই প্রবাসী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, কার্গো খরচ বেশি হওয়ায় সহজে লাশ পরিবহন করা সম্ভব হয় না। টাকা তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। সরকার দায়িত্ব নিলেই শেষ যাত্রা নিয়ে অন্তত নিশ্চিন্ত হতে পারেন প্রবাসী কর্মীরা।
আমিরাতে দুটি বাংলাদেশ মিশনের তথ্য বলছে, এক বছরে সেখান থেকে দেশে ফিরেছে ৬৪২ রেমিট্যান্সযোদ্ধার মরদেহ। তাদের মধ্যে সরকারি অর্থায়নে ফিরেছে ৫৯টি। তাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে আবুধাবি দূতাবাস ২১ জনের মরদেহ পাঠাতে ব্যয় করেছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ও দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেট ৩৮ জনের মরদেহ পাঠাতে খরচ করেছে ২৩ লাখ টাকার মতো।
আবুধাবি দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর হাজেরা সাব্বির হোসেন জানান, আমিরাত থেকে একজন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচ হয় ৪ হাজার ৩০০ দিরহাম থেকে ৫ হাজার দিরহাম পর্যন্ত। বাজেট সংকুলান না হওয়ায় সবগুলো মৃতদেহ সরকারি খরচে দেশে পাঠানো সম্ভব হয় না। তাই অধিকাংশ প্রবাসীর লাশ পাঠাতে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিত্তবানদের সহযোগিতা নেওয়া হয়।
গত এক সপ্তাহে দুবাই থেকে আরও পাঁচজন ও চলতি মাসে আবুধাবি থেকে ১২ প্রবাসীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। আবুধাবি থেকে সর্বশেষ গত ২৩ আগস্ট দেশে ফিরেছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মামুনুর রশীদ, ২১ আগস্ট হাটহাজারীর আবদুল হামিদ ও ফটিকছড়ির আবু নাসের, ১৮ আগস্ট সন্দ্বীপের আবদুল হান্নানের মরদেহ। দুবাই থেকে গত এক সপ্তাহে সর্বশেষ দেশে ফিরেছে নওগাঁর আবু তাহের, নরসিংদীর উত্তম কুমার শীল, কুমিল্লার খুরশেদ আলম, লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ নুর হোসাইন ও নোয়াখালীর মাইন উদ্দিনের মরদেহ। তাদের প্রায় সবার মরদেহ দেশে ফিরেছে পারিবারিক খরচ, সহকর্মীদের অনুদান ও বিত্তবানদের সহায়তায়।
দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের লেবার উইং জানায়, স্থানীয় বিভিন্ন মর্গে এখনও কয়েকজন প্রবাসীর মরদেহ পড়ে আছে। অর্থাভাবে তাদের দেশে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা হলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কাজীম উদ্দিনের ছেলে নাজমুল হক, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার ফিরোজ আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ আইয়ুব, ফটিকছড়ি উপজেলার আবদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার হাকিম উদ্দিন মুনশির ছেলে হারুন-আর-রশিদ মুনশি। এ ছাড়া গত ১০ দিনে আরও ১১ প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
সমকাল। ২৯। ০৮। ২০২৩
Discussion about this post