ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মীয়তা সম্পর্কের গুরুত্ব দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে কিছু চাও এবং রক্ত সম্পর্কীয় সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন কর।’ অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধন ছিন্ন করো না। (আননিসা-১)।
আল্লাহ পাক আরও বলেন, ‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এসব যারা করবে, তাদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।’ (সূরা মুহাম্মদ : ২২, ২৩)।
সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ক্ষুণ্নকারী ও মদখোর কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না।’ সুতরাং যে লোক নিজের অসহায় দরিদ্র আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের পরিত্যাগ করে, তাদের প্রতি অহংকার ও দম্ভ প্রকাশ করে, সে বিত্তবান আর তারা দরিদ্র এ ধরনের অবস্থায় সে দয়া দাক্ষিণ্য ও সহায়তা দ্বারা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় না রাখে বরং গর্বিত মনোভাব নিয়ে আত্মীয়তা বন্ধনে চিড় ধরায়, উল্লেখিত হুঁশিয়ারি ও সতর্কতা অনুযায়ী সে জান্নাতে প্রবেশের অনুমিত পাবে না।
শুধু আল্লাহর কাছে তাওবা ও আপনজনের সঙ্গে সদাচরণের মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নের দ্বারাই এ পরিণাম থেকে পরিত্রাণের আশা করা যেতে পারে। আর এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন দুর্বল, দরিদ্র হয়, সে যদি তাদের প্রতি বদান্যতা না দেখিয়েছেন বরং নিজের দান সদকা তাদের না দিয়ে (দূরের) অন্য কাউকে দেয়, আল্লাহ তার দান দক্ষিণা কবুল করবেন না এবং হাশরের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাতও করবেন না।’
(তাবরানি) যদি নিজেই দরিদ্র হয়, তাহলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ এবং খোঁজখবর রাখার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা উচিত। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সালাম দেওয়ার মাধ্যমে হলেও আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখ।’ রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে লোক আল্লাহ ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিজি)।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে আল্লাহ পাক তার রিজিক বৃদ্ধি করে দিক এবং তার হায়াত বৃদ্ধি করে দিক, তাহলে সে যেন আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।’ হাদিসে কুদসিতে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক বলেন, আমার নাম ‘রহমান’ (পরম দয়ালু), আর আত্মীয়তার সম্পর্ককে বলা হয় ‘রহম’ যে লোক তা অক্ষুণ্ন রাখে-আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করি। আর যে তা ক্ষুণ্ন করে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)।
হজরত আলি (রা.) তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে বৎস! কখনো রক্ত সম্পর্ক ছিন্নকারীর সঙ্গে চলবে না। কেননা আমি আল্লাহর কিতাবে তিন জায়গায় তাদের অভিশপ্ত আখ্যায়িত হতে দেখেছি।’ কথিত আছে যে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একবার এক সভায় রাসূল (সা.)-এর হাদিস বর্ণনাকালে বললেন, ‘আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারী এ সভা ছেড়ে চলে যাও। কেননা তার সঙ্গে একত্রে বসতে আমি বিরক্ত বোধ করি।’
এ কথা শুনে সভাস্থলের পেছন দিক থেকে এক যুবক উঠে চলে গেলেন। এবং সে তার ফুফুর কাছে চলে গেল। যার সঙ্গে তার বহু বছর ধরে সম্পর্ক খারাপ ছিল। সে তার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করল। ফুফু বললেন বেটা! তুমি কী জন্য এ কাজ করলে? সে জবাবে বললেন, রাসূল (সা.)-এর প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এক সভায় বলেছেন, যারা আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করেছ তারা আমার সভাস্থল ত্যাগ কর। তার ফুফু বললেন, তুমি আবু হুরায়রার কাছে গিয়ে জিঙ্গেস করবে, এটা বলার কারণ কী? সে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর কাছে এসে সবকিছু বিস্তারিত বলে জিজ্ঞেস করলেন, আত্মীয়তা সম্পর্ক ক্ষুণ্নকারী আপনার কাছে বসতে পারবে না কেন?
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, এমন সভাস্থলে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় না, সে সভায় রক্ত সম্পর্ক ক্ষুণ্নকারী কোনো লোক যদি থাকে। (তারগির তারহিব)। অতএব, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গুনাহ। এ থেকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে আত্মীয়দের সঙ্গে যথাযথ সম্পর্ক রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন!
ড. মো. গোলাম কিবরিয়া
লেখক : পির সাহেব, খানকায়ে জাব্বারিয়ায়ে চিশতিয়া, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ
Discussion about this post