ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে জীবিকার তাগিদে ঘর ছেড়ে, পরিবার, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে, নিজের মাতৃভূমি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বিদেশে অবস্থান করতে হয় প্রবাসীদের। শান্তিময় সেই প্রবাস জীবন অনেক সময় অত্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠে রুমমেট কিংবা সহকর্মীর কারনে।
একজন প্রবাসী তার মা-বাবা , স্ত্রী-সন্তান, পরিবারকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে যায়। আর পরিবারকে ভালো রাখতে তাকে স্বীকার করতে হয় অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা। কাজের চাপ, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, প্রখর রোধ বৃষ্টি, সময়মত কাজে যোগদান, সময়মত ঘুম থেকে জাগা, সময়মত ঘুমোতে যাওয়া, খাবার দাবার, সাংসারিক চাপ, আর্থিক চাপ. বিভিন্ন প্রকার মানষিক চাপ- এগুলো সহ্য করে নিতে হয় নির্দ্বিধায়। আর বিনোদন করার মত সময় সুযোগও হয় না তাদের। যা বিনোদন সব এখন হাতের মুঠোয়, খেলাধুলা, শরীর চর্চা এগুলো অনেকের ভাগ্যের ব্যাপার। এতকিছুর পর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বেপার হলো প্রবাসীদের থাকার পরিবেশ যদি ভালো না হয় তবে আর ভোগান্তির শেষ নাই।
অনেক্ষেত্রে ওয়াশরুমে বা গোসলেও সিরিয়ালের অপেক্ষায় থাকতে হয়। তারমধ্যে, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসে যদি পরিবেশগত কারণে ঠিক মত ঘুমানো না যায় তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগা প্রবাসী আর হয় না। তার উপর যদি রুমমেট ম্যাচিং না হয় মরার উপর যেন খরার ঘাঁ। রুমের কোন একজন সদস্য বদমেজাজি, অসদাচারী, খুনসুটি, হিংসুটে, হীনমন্য হয়ে থাকে তাহলে অন্য প্রবাসীর জীবন হয়ে উঠে খুবই দুর্বিষহ। নানান প্রবাসীদের অভিজ্ঞতার আলোকে- প্রবাসী জীবনকে দুর্বিষহ করার পেছনে রয়েছে রুমে যদি এমন কিছু সদস্য হয়ে থাকে- কাউকে সম্মান করে না, নিজের মত নিজে চলাফেরা করে বাকিদের কি ডিস্টার্ব হয় না হয় সে কথা ভাবে না, মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলা, কেউ ঘুমিয়ে আছে তার ঘুমের তোয়াক্কা বা তার সুবিধা অসুবিধার কথা না ভাবা, হেডফোন ছাড়া মোবাইলে ভিডিও দেখা বা হেডফোন ছাড়া মোবাইলে লাউডে কথা বলা, রুম পরিচ্ছন্ন না রাখা, ওয়াশরুম ব্যবহার করে নোংরা করে বের হওয়া, ওয়াশরুম নিয়মিত পরিস্কার না করা, রুমের পরিস্কার তো দুরে থাক কেউ কেউ নিজের শরীর ঠিক মত পরিস্কার রাখে না, নিয়মিত গোসল করে না, কারনে অকারণে অন্যদের দোষত্রুটি খোজা, অন্য রুমমেটদের সঙ্গে বিবাদ করা।
শুধু যে একজন রুমমেট খারাপ হলেই প্রবাস জীবন দুর্বিষহ হয় তা কিন্তু না। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও এরকম দু একজন সহকর্মী থাকে যাদের মধ্যে, স্বভাব চরিত্রের কারনে কর্মক্ষেত্রও দুর্বিষহ হয়ে উঠে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে যদি এমন সহকর্মী থাকে- একজন অন্যজনের ভালো কিছু ভালোভাবে মেনে নিতে কষ্ট হয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ, স্বার্থপর, সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ, নিজেকে বড় কিছু ভাবা, সহকর্মীদের সঙ্গে কারনে অকারণে জুট ঝামেলা পাকানো, কূটকৌশল অবলম্বন, গিরিঙ্গিবাজ, সহকর্মী পদোন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ানো, শত্রু মনোভাব পোষণ, গিরিগিটী আচরনের কারনেও প্রবাস জীবন হয়ে উঠে অত্যন্ত দুর্বিষহ।
ভালো রুমমেট কিংবা ভালো সহকর্মী মানেই পরিবার না হোক, অন্তত একটা সম্মানজনক সহাবস্থান। পরিবারের কথা ভেবে, নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে কিংবা সে টকসিক পার্সন যার কারণে বিরক্তিকর জীবন যাপন করেন তার সম্মানে হয়তো নিরবে সয়ে থাকে অধিকাংশ প্রবাসী। কিন্তু অতিরিক্ত দুঃসহ যন্ত্রণা নিরবে সবাই সইতে পারে না, যার কারণে ঘটে থাকে কলহ বিবাধ, মারামারি থেকে শুরু করে প্রাণ নাশের মত ঘটনা।
বিদেশে এসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শুধু টাকা উপার্জন করাই যথেষ্ট নয়, আর নিজের স্বার্থকে সবসময় বড় করে না দেখা, রুমমেট বা সহকর্মীর কোন অশান্তির কারন না হওয়া, অন্যদেশের নাগরিকদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করা, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এমন কিছু না করা, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, আস্থা, ভালোবাসা, সম্মান প্রদর্শন করা, নিজেকে সভ্য শান্ত জাতি হিসেবে অন্য জাতির সামনে উপস্থাপন করা প্রতিটি প্রবাসীর নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য।
লেখক: মাহবুব সরকার।
প্রবাসী সাংবাদিক, সংযুক্ত আরব আমিরাত।