ভিসা, টিকিট ও এজেন্সির যোগসাজসে বিমানবন্দর অতিক্রম করতে পারলেই মিলবে সোনার হরিণ। ভ্রমণে গেলে পাওয়া যাচ্ছে কাজ, করা যাচ্ছে ভিসা। এমন প্রলোভন আর স্বপ্নের ঘোরে প্রতিদিন শত শত তরুণ পাড়ি দিচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এদের মধ্যে দক্ষ ও ভাষাজ্ঞানে পারদর্শীরা কাজ পেলেও নানাভাবে প্রতারণার জালে আটকে যাচ্ছেন অদক্ষ ও অনভিজ্ঞরা। দ্বারে দ্বারে ঘুরে হচ্ছেন প্রতারণার শিকার।
ভুক্তভোগীদের দাবি, ভিসা ইস্যুতে প্রতারণার প্রথম ফাঁদ পাতা হয়। ব্যাংক ডিপোজিটসহ ৯০ দিনের যে ভ্রমণ ভিসা পাওয়া যায় মাত্র ৪০ হাজার টাকায়, সেই ভিসা নিতে হয়েছে তাদের আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায়। কাগজে কলমে এজেন্সি থেকে নেওয়া হলেও নানাজনের হাত ঘুরে ভিসাগুলো ভ্রমণকারীদের হাতে আসে। দেশ ছাড়ার আগে কাজ পাওয়ারও মৌখিক চুক্তিবদ্ধ হন এসব তরুণরা। কিন্তু আমিরাত পৌঁছালে দেখা মিলে দৃশ্যমান সকল বাস্তবতার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহরাব হোসাইন ভিজিট ভিসা কিনে ফেব্রুয়ারি মাসে পা রাখেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী, কাজ না দিয়ে তাকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এই কাজে অসম্মতি জানিয়ে মেহরাব পড়েন বিড়ম্বনায়। দালাল চক্র তাকে বাড়তি এক লাখ টাকা পরিশোধের চাপ সৃষ্টি করে। অন্যথায় পাসপোর্ট জব্দ করারও হুমকি আসে।
মেহরাব হোসাইন জানান, রুটি-রুজির জন্য আমিরাত এসে গত কয়েকদিন না খেয়ে রোজা পালন করতে হয়েছে। তার সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠানের প্যাকিং বিভাগে কাজ দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল দালালদের সঙ্গে। কিন্তু তাকে পাঠানো হয় নির্মাণকাজে। ওই কাজ না করে দেশে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে মেহরাবকে নানা হুমকি-ধামকিসহ স্থানীয় পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়।
মৌলভীবাজারের আবদুস সামাদ একবুক আশা নিয়ে ভ্রমণ ভিসায় এসেছেন আরব আমিরাত। একজন পাকিস্তানির সঙ্গে চুক্তি করে তার ভাই এই ভিসার ব্যবস্থা করেছিলেন। শর্ত অনুযায়ী একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরিও হয় তার। চাকরিতে মাসের পর মাস কেটে গেলেও বেতনের দেখা নেই। যার মাধ্যমে কাজ পেয়েছে সেও এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সামাদের মতো সিলেটের আরেক তরুণ তরিকুল ইসলামও একই সমস্যায় ভুক্তভোগী। একটি সাপ্লাই কোম্পানিতে তারা ৪০ জন কর্মী কাজ করতেন। কিন্তু বেতন বকেয়া রেখে এখন সেই কোম্পানি উধাও।
মোহাম্মদ রাফি নামে আরেকজন প্রবাসী অভিযোগ করে বলেন, ছোট ভাইকে ভিজিটে এনেছিলাম। যাও একটি কাজের ব্যবস্থা হয়েছে আমিরাতের তাপমাত্রা সহ্য হচ্ছে না তার। এখন মনস্থির করেছে দেশে ফিরে যাবে। এই কথা শুনেই নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান বেঁকে বসেছে। আটকে রেখেছে তার মূল পাসপোর্ট।
শুধু এরাই নয় অভিযোগ আছে, ভ্রমণ ভিসা নিয়ে আমিরাতে প্রবেশ করা প্রতি দশ হাজারের মধ্যে ন্যূনতম ২ হাজার তরুণ হচ্ছেন প্রতারণার শিকার। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নামে-বেনামে আইডি তৈরি করে কাজের প্রলোভন দেখায় প্রতারক চক্র। অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ভ্রমণ ভিসাধারীরা এসব চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে পড়েন বিড়ম্বনায়। ‘কর্ম খালি আছে’ মর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালায় ওসব চক্র। কাজ দেওয়ার নামে আগ্রহীদের থেকে অগ্রিম অর্থ আদায় করে এরা। টাকা পেয়ে গেলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ওইসব আইডি। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে নামসর্বস্ব কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেও বেতন বকেয়া পড়ে যায় মাসের পর মাস। এক পর্যায়ে কাজ আদায় করা এসব কোম্পানিও উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে করে কেউ হারাচ্ছেন নগদ অর্থ, কেউবা হারাচ্ছেন ভ্রমণ ভিসার নির্ধারিত মূল্যবান সময়।
এদিকে, শ্রমিক ভিসা পাওয়া বা ভিসার ধরণ পরিবর্তনের আগে ভ্রমণ (ভিজিট) ভিসাধারীর সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরাসরি কাজ করার সুযোগ নেই। বৈধ কাজের ভিসা ব্যতীত ভ্রমণ ভিসা থাকা অবস্থায় কাজ করলে ৫০ হাজার দিরহাম পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে দেশটিতে, যা বাংলাদেশি প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, দেশটিতে নাগরিক জীবনযাত্রা যত আধুনিকায়ন হচ্ছে ততই বাড়ছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির চাহিদা। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে সর্বত্র। বিশেষ করে কর্মীর দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা ও ভাষাজ্ঞানের উপর প্রাধান্য দিচ্ছে কর্মীর চাহিদা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই হিসেবে ক্রমেই দেশটিতে কমে আসছে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞদের কাজের সুযোগ।
কামরুল হাসান জনি
দৈনিক সমকাল
Discussion about this post