পাঁচ বছর পর দেশে ভোটের আয়োজন। ভোটকে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার ভেবে, আপনি ভোট দিতে চলে আসলেন সুদূর আমেরিকা থেকে। একটা ভোটের জন্য এত কষ্ট করে যখন ভোটকেন্দ্রে গেলেন, জানতে পারলেন কোনো এক হৃদয়বান লোক আপনার ভোটটি দিয়ে দিয়েছে। আপনি হতভম্ব!
দৃশ্যটা একটি তামিল সিনেমার। বিজয় অভিনীত সর্বশেষ “সরকার” সিনেমার দৃশ্যে দেখানো হয় জাল ভোটের চালচিত্র। এই সিনেমাটি তামিল ইন্ডাস্ট্রির হলেও, বাংলাদেশে যারা দেখেছেন তাদের মধ্যেও সিনেমাটি নিয়ে ভীষণ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। অনেকে এই সিনেমার সাথে সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশের নির্বাচনের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
তামিল সিনেমা নিয়ে অনেকের নাক সিঁটকানো বাতিক আছে। কারণ, এই সিনেমাগুলো অতিমাত্রায় কমার্শিয়াল, অবাস্তব দৃশ্যকল্প দিয়ে ভরা, অপ্রয়োজনীয় নাচাগানা দিয়ে ভর্তি। কিন্তু, তামিল সিনেমা যে পাক্কা কমার্শিয়াল বিনোদন দেয়া সিনেমা গল্পের মধ্যেও এক চিমটি করে সোশ্যাল মেসেজ ঢুকিয়ে দেয়, সেটাকে এপ্রিশিয়েট না করে পারা যায়না। বিশেষত, তামিল ইন্ডাস্ট্রির তুমুল জনপ্রিয় নায়ক বিজয় যাকে আদর করে ফ্যানরা বলে ‘থালাপাতি’ তার সর্বশেষ সিনেমাগুলো খেয়াল করলেই বোঝা যায়। সোশ্যাল ইস্যু নির্ভর একটি গল্পকেই কমার্শিয়াল সিনেমায় রুপ দেয়া প্লটের ধারাবাহিকতা মেনে এবার বিজয় উপহার দিলেন ‘সরকার’ সিনেমাটি। সিনেমাটির প্রথম অর্ধ দারুণ সূচনা দিলেও, দ্বিতীয় অর্ধ টিপিক্যাল পলিটিক্যাল সিনেমার ফিনিশিংয়ের মতোই শেষ হয়েছে। পরিচালক মুরুগাদস এই জায়গায় কিছুটা শিথিল ছিলেন বলেই মনে হয়।
সিনেমার শুরুতে আমরা দেখতে পাই, ভারতীয় কর্পোরেট কোম্পানির এক জরুরি মিটিং। তারা আতঙ্কে আছেন মারাত্মক। কারণ, ভারতে ফিরে আসছেন কর্পোরেট জগতের এক তুখোড় লোক, যে ভারতীয় হয়েও বিশ্বের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট কোম্পানির সিইও। তার নাম সুন্দর রামাস্বামী। এই লোকটির বিশেষত্ব হলো, সে ব্র্যান্ড ধ্বংস করে দিতে ওস্তাদ। যে দেশেই সে যায়, ওই দেশের কোনো ব্র্যান্ডকে টার্গেট করলে আর রক্ষা নাই, বারোটা বাজিয়ে দেয়।
সুন্দর রামাস্বামী চরিত্রেই অভিনয় করেছেন বিজয়। তিনি যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন সবার কৌতূহল তার দিকে। কেন আসলেন তিনি দেশে? সবার কৌতূহলে ঘি ঢেলে দিয়ে কয়েকটি গাড়ির প্রটোকল নিয়ে সুন্দর গেলেন তার নিজ এলাকার ভোটকেন্দ্রে। তিনি দেশে ফিরেছেন এতদিন পর, শুধু নিজের ভোটটা দিয়ে। চারঘন্টা পর আবার ফিরে যাবেন। কিন্তু, কি অদ্ভুত লীলা। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারলেন তার ভোটটি যত্ন করে অন্য কেউ দিয়ে গেছে। বেশ শোরঘোল পড়ে গেল। বিশ্বের সেরা কোম্পানির সিইওর ভোট জালিয়তি!
কিন্তু, সুন্দর মেনে নিলেন না ঘটনা। যেহেতু তিনি কর্পোরেট লাইনের লোক, তাই ঘটনার লজিক্যাল কারণ খুঁজতে লাগলেন। অভিযোগ দিলেন সংশ্লিষ্টদের কাছে। কেউ প্রতিকার দিতে পারলো না। পলিটিশিয়ানরা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও আশায় ছিল সুন্দর চার ঘন্টা বাদে আবার বিদেশ ফিরে যাবে। ভোট জালিয়তির ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু, প্রতিকার না পেয়ে সুন্দর কোর্টের দ্বারস্থ হলেন। এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার ভোট দিয়েই তিনি বিদেশ ফিরবেন। তিনি দাবি জানান, তার ভোট দেয়ার আগ পর্যন্ত যেন ফলাফল স্থগিত রাখা হয়। যদিও সবাই বলছিল, একটা ভোটে তো আর ফলাফল পাল্টাবে না। কিন্তু, সুন্দর অটল রইলেন, কারণ ভোট তার সাংবিধানিক অধিকার। সুন্দর আদালতে নির্বাচনী আইনের একটি ধারা উপস্থাপন করে দেখালেন। সেকশন ৪৯-পি। যেই আইনটির কথা চর্চার অভাবে আদালতের লোকজনরাও বিস্মৃত হয়েছিলেন যেন।
এই ঘটনা থেকেই সিনেমার ঢালপালা মোড় নিতে থাকলো ভিন্ন দিকে। আইনে কি বলা হয়েছে? সুন্দর কি ভোট দিতে পেরেছেন কি না? এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে সিনেমাতেই। একটা ভোট দিতে এসে সুন্দরকে লড়তে হয়েছে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবার লড়াই। সেই লড়াইয়ের গল্প কিভাবে লড়েছেন সেটাই আমরা দেখতে পাই সিনেমায়।
সিনেমায় বেশ কিছু সোশ্যাল মেসেজ দেয়া হয়েছে। পলিটিশিয়ানরা কিভাবে ম্যানিপুলেট করে তার একটা ধারণা পাওয়া যায় এই সিনেমায়। মানুষকে কিভাবে হাতিয়ার কিংবা শিকার বানানো হয়, কিভাবে মানুষের অধিকারকে পুঁজি করে রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন তারও কিছু চালচিত্র আমরা দেখতে পাই।
এই সিনেমাটির সাথে আমাদের দেশের নির্বাচনের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ নির্বাচনে ৮০ ভাগের উপরে ভোট কাস্ট হয়েছে বলে আমরা জানলেও, এটাও দেখি অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তারা নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি। অনেক ভোট কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের আগেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ। বিরোধী দলগুলো বলছে, ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে জাল ভোট দিয়ে ভর্তি করে রাখা হয়েছে। যদিও, নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছিল, কারো ভোট যদি অন্য কেউ দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রেও আসল ব্যাক্তি ভোট দিতে পারবেন। টেন্ডার ভোট বলা হয় একে। কিভাবে টেন্ডার ভোট দেয়া যাবে সেটি জানানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে৷ অবশ্য বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট দিতে বাধা দেয়া হয়েছে কিংবা ভোটার স্লিপ না পাওয়ায় অনেকে ভোট দিতে পারেননি এমন ঘটনার অভিযোগ এসেছে এই নির্বাচনকে ঘিরে।
যাইহোক, দর্শকরা একটা সিনেমাকে যেভাবে দেখেন, তার ইন্টারপ্রিটেশন তার কাছে ওরকমই হবে। কিন্তু, সিনেমার সাথে বাস্তবতার ফারাক আছে। এটিও বুঝতে হবে আমাদের। রাজনীতিকে রাজনৈতিক চোখেই দেখতে হয়, সিনেমাকে সিনেম্যাটিক বিচারে। অনেকেই বলছেন, এই ধরণের সিনেমা বাংলাদেশে বানানো সম্ভব না। পরিচালক, নায়ককে গুম করে ফেলা হবে। এই ধরণের একটা কথা চালু হয়ে যাওয়াটা ব্যাক্তিগতভাবে আমি সমর্থন করি না। ভয় ছিল না এমন কোনো সময় নাই৷ বায়ান্ন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সবসময়ই মানুষকে বিভিন্ন ধরণের ভয়কে জয় করে সামনের দিকে আগাতে হয়েছে। তাই এখন কিছু বলা, কিছু করাই ভীষণ বিপদের কারণ হবে, এমনভাবে ভাবতে চাই না।
যাই হোক সরকার সিনেমা দেখে একটা কথাই বলি, ভয় না ছড়িয়ে নিজের অধিকারটা কিভাবে বুঝে নিতে হয় সাধারণ মানুষ হিসেবে, এই সিনেমা থেকে শুধু সেই শিক্ষাটা নিতে পারেন। কিছু সোশ্যাল মেসেজ আছে, সেগুলোও বোঝার চেষ্টা করুন। শিক্ষা নেওয়াটা অবশ্য জরুরী না, সিনেমাটা উপভোগ করুন, এটাই যথেষ্ট। দারুণ দারুণ সংলাপ আর বিজয়ের পারফরমেন্স দেখতে দেখতে ১৬১ মিনিট ভালভাবেই কেটে যাবে, আশা করা যায়…
সেলিব্রেটিবিডি/এইচআর
Discussion about this post