বলিউডের জন্য ২০১৮ গল্প নির্ভ রএকটি বছর। ২০১৭ তে একইসাথে কন্টেন্ট+বক্স অফিসের দিক দিয়ে বেশ বাজে একটা বছর কাটিয়েছিল বলিউড সেখান থেকে ২০১৮ তে এসে কন্টেন্টের দিক দিয়ে হোক কিংবা বক্স অফিস, দুদিকেই সফলতা ধরা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে, এই বছরে এসে স্পষ্ট হল সুপারস্টার তকমা দিয়ে আর সিনেমা বিক্রি করা যাবে না। সিনেমার গল্প ভালো না হলে বড় সুপারস্টাররাও সে সিনেমা বাঁচাতে পারবেন না। উল্টোদিকে ভালো গল্পের সিনেমাতে কোন স্টার না থাকলেও সে সিনেমা বক্স অফিসে সফল হতে দেখা গিয়েছে বারবার। এসবের মাঝ থেকে এ বছরের সেরা ১০ টি বলিউড সিনেমা নির্বাচন করা একটু কঠিনই। তবে এবারই সালতামামিতে বোধহয় কন্টেন্ট ড্রিভেন সিনেমার আধিক্য বেশি থাকবে সুপারস্টারড্রিভেন সিনেমার চেয়ে। চলুন দেখে নেয়া যাক এ বছরের সেরা ১০ টি বলিউডি সিনেমার তালিকা-
১০) স্ত্রী– হরর কমেডি জনরা নিয়ে বলিউডে কাজ হয়েছে খুব কম। আর যখন করা হয়েছে তখন সেগুলো না হরর হয়েছে না ই বা কমেডি। তো এ বছর ‘স্ত্রী’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পেলো এই জনরায়। মুক্তি পাবার আগ পর্যন্ত কেউ কল্পনাই করে নি যে এ বছরের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ হিট হতে যাচ্ছে এই সিনেমাটি। হরর-কমেডি তকমা থাকলেও এই সিনেমা শতাব্দী পুরোনো এক মিথকে সঙ্গী করে বর্তমান যুগের নারীদের স্বাধীনতা হরণ নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে কটাক্ষ করে ভূতের রুপকে পুরুষদের সেই স্বাধীনতাহীনতার স্বাদই যেন দিয়ে গেছে। আর সেটাই দর্শক লুফে নিয়েছে। রাজকুমার রাও আর পঙ্কজ ত্রিপাঠির অভিনয় ছিল আসলেই দেখার মতো।
৯) সঞ্জু– সঞ্জয় দত্তের উত্থান-পতন সবসময়ই যেন সিনেমার গল্পের মতো মনে হতো। রাজকুমার হিরানীর হয়তো একটু বেশিই মনে হতো। তাই তো সঞ্জয় দত্তের জীবনী নিয়েই বানিয়ে ফেললেন সঞ্জু। নামভূমিকায় অভিনয় করলেন হালের ক্রেজ রনবীর কাপুর। একদিক থেকে যেমন সঞ্জুরও উঠে আসা লাগতো অন্ধকার জগত থেকে অন্যদিকে রনবীরের কাছে একটা হিট পাওনা ছিল তার দর্শকরা। আর সেটাই সম্ভব হল রাজু হিরানীর হাত ধরে। রাজু হিরানীর সুপারহিট ট্র্যাক রেকর্ডে নতুন পালক যুক্ত হল সঞ্জুর হাত ধরে। রনবীরের দারুণ অভিনয় আর সঞ্জয় দত্তের উত্থান-পতনময় জীবন দর্শক দু চোখ ভরে দেখলেন। হয়তো সঞ্জয়ের ইমেজ ক্লিনও হল কিছুটা এর মধ্য দিয়ে, কিন্তু দর্শক যেহেতু ভালোবেসে গ্রহণ করেছে সেখানে বাড়তি কথা বলার দরকার নেই।
৮) মুল্ক– ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে সিনেমা কম হচ্ছে না পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু সবসময় কেন্দ্রে থাকতো ইউএস বা ইউকে। কিন্তু উপমহাদেশেও যে শিকড় গেঁড়ে নিয়েছে এই বীজ তা হয়তো মুল্কই প্রথম দেখালো। টেরোরিস্ট মানেই এখন মুসলমান কিন্তু সে টেরোরিস্টের পরিবারকে কীসের মুখোমুখি হতে হয়, তাদেরও টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে কীভাবে দেশের প্রতি বিষিয়ে তোলা হয় সেসব বিষয়ই উঠে এসেছে এই সিনেমায়। এক টেরোরিস্টের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে ধর্মের কারণে নিজ দেশ থেকে বিচ্যুত করার যে অসহিষ্ণু প্রক্রিয়া সেটিই উঠে এসেছে। ঋষি কাপুর আর তাপসী পান্নুর অনবদ্য অভিনয়, মুসলমানদের বাঁকা চোখে দেখা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচয় যেন এক নতুন সত্যের মুখোমুখি করে দিয়েছে দর্শককে।
৭) ভবেশ জোশি সুপারহিরো– এই সিনেমাটি এই বছরের অন্যতম ফ্লপ একটি সিনেমা। দর্শক সিনেমাটি দেখতে যায় নি, নাকি দেখতে গিয়ে বুঝতে পারে নি সেটা জানা দরকার। অনেকে আবার ভি ফর ভেনডেট্টা কিংবা ডার্ক নাইট ট্রিলজির সাথে সাদৃশ্য টানলো কিন্তু আমার কাছে তেমন কিছু মনে হয় নি। বরং মনে হয়েছে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সুপারহিরো তো এমনই হবার কথা। না ভবেশ জোশি পৃথিবী বাঁচাতে পারা বা শহর বাঁচাতে পারা কোন সুপারহিরো না। সে কেবল পানি বাঁচাতে চেয়েছে মানুষের জন্য, পানি মজুদ করে ক্রাইসিস সৃষ্টি করা বাস্তবিক অসৎ অমানুষদের সাথে লড়াই করে গেছে ক্রমাগত। পুরো সিনেমাটাই তাই বাস্তবিক এক সুপারহিরোর। যে কীনা আর দশটা ছেলের মতোই সাধারণ, ভীতু। অনেকের অপছন্দের, অনেকের অজানা এই সিনেমাই তাই আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা এই বছরের।
৬) রাজি– মেঘনা গুলজারের ‘তালভার’ সে বছরেরই হয়তো সেরা সিনেমা ছিল, তার দ্বিতীয় সিনেমা রাজিও কম কিছু না। ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই সেহমত নামের এক ভারতীয় মেয়েকে যাকে ইন্টেলিজেন্স পাচার করার জন্য বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের এক সেনাপরিবারে। জীবন ঝুঁকি নিয়ে সেহমতের সেই দিনগুলোর গল্প নিয়েই রাজি। এখানে দেশ বলতে কেবল একটা মানুষ, যে তার সমস্ত সত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে আত্মত্যাগ করতে রাজি হয়ে যায়। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সে পরিবারটির মানবিকতাও চোখে পড়ে, কিন্তু যেখানে দেশ সবার ওপরে সেখানে মানবিকতার জায়গা খুব কম। আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। কেননা, এই মানবিকতাই অনেক অমানবিক হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে যেটা দূর থেকে খালি চোখে বোঝা সম্ভব না। সেরকমই এক আত্মত্যাগের গল্প বলে যায় রাজি।
৫) আন্ধাধুন– মাস্টার থ্রিলার মেকার শ্রীরাম রাঘবনের ‘আন্ধাধুন’ এ বছর মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছে দর্শকদের। একজন অন্ধ পিয়ানো বাদক, একটি খুন ও সাক্ষী হিসেবে সে অন্ধ- এমনই এক রহস্যময় গল্প নিয়ে আন্ধাধুন রীতিমত খেলা করেছে দর্শকদের সাথে। কী হল, কীভাবে হল আর কেন হল- এই প্রশ্ন নিয়ে সদাব্যস্ত থাকা দর্শক শেষে গিয়ে ওপেন এন্ডেড কনক্লুশন দেখে মাথা খারাপ করে ফেলে। আর এই কনফিউশনাল এন্ডিংই যেন আন্ধাধুনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আয়ুষ্মান আর টাবুর অসামান্য অভিনয়, মাস্টাফুল সব পিয়ানো পিস আর মুহূর্তে মুহূর্তে গল্পের বাঁকবদল এই সিনেমাকে এ বছরের অন্যতম দর্শকপ্রিয় সিনেমা করে তুলেছে
৪) প্যাডম্যান- এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা বললে হয়তো আমি এটার কথাই বলবো। অক্ষয় কুমার সমাজিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সিনেমা করছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই। সেজন্য হয়তো একটু লো এক্সপেক্টেশন নিয়ে দেখেছিলাম প্যাডম্যান। কিন্তু সিনেমাশেষে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি এ ইস্যুর এক্সিকিউশন, গল্পে ব্যবহার ও হাই এন্টারটেইনমেন্ট কোশন্ট দেখে। অক্ষয় কুমারেরও ওয়ান অফ দ্য ফাইনেস্ট পারফর্মেন্স বলে আমি বিবেচিত করবো প্যাডম্যানকে। এই সিনেমা যদি একটা মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারে স্যানিটারি ন্যাপকিন ইউজের জন্য তাহলে সেটাই হবে এই সিনেমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
৩) বাধাই হো- এ বছরের সেরা পারিবারিক সিনেমা। একসময় বলিউডে পারিবারিক সিনেমা মানে বিশাল বাড়ি, হেলিকপ্টার, যৌথ ধনাঢ্য পরিবার আর সন্তানদের বিয়ে-প্রেম নিয়ে টানাপোড়েনই দেখানো হতো। বাধাই হো-তে এসবের কিছুই নেই। একদম বাস্তবিক একটি মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যেখানে রুমের সঙ্কট, বাবা কৃপণ, দাদীর খিটির মিটির আর দুই ভাইয়ের খুনসুটি আছে। এরই মাঝে একদিন ছেলেরা খবর পায় তাদের বাবা-মা আবার সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছেন। এই নিয়ে সমাজের খোঁটা, প্রতিবেশির হাস্যরস, সন্তানদের অকওয়ার্ড সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করা আর দাদীর পৃথিবীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বকাঝকা করা নিয়েই বাধাই হো। গজরাজ রাও আর নীনা গুপ্তাই যে গল্পের প্রধান দুই চরিত্র। মধ্যবয়সে এসে কেন ভালোবাসা হারিয়ে যাবে, কেন সন্তান জন্মদান করা পাপ হয়ে যাবে একটা বয়স পার হয়ে এসে সেগুলোই উঠে এসেছে অসম্ভব সুন্দর এই সিনেমাতে।
২) অক্টোবর– EMPATHY- এই একটা শব্দই পুরো অক্টোবর সিনেমাকে ধারণ করে নেয় যেন। সুজিত সরকার তার ব্যক্তিগত একটা গল্পই বললেন যেন অক্টোবর সিনেমাটির মধ্য দিয়ে। মানুষের মাঝে মানবিকতা খুঁজে বেড়ালেন যেন রাইটার জুহিকে নিয়ে। শিউলি ফুলের ঘ্রাণমাখা পুরো সিনেমাতে বরুন কীভাবে এতো ম্যাচিওর একটা পারফর্মেন্স দিলেন সেটাই অবাক করে দিয়েছে। খুব স্লো পেসের এই সিনেমা মনকে একটা প্রশান্তি এনে দেয়। এই প্রশান্তি সিনেমা দেখে ভালো লাগার প্রশান্তি না কেবল সাথে জীবনকে নতুন করে বুঝতে পারার প্রশান্তিও।
১) তুম্বাড়– তুম্বাড়ের সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স আমার কাছে এ বছরেরই সেরা এক্সপেরিয়েন্স (ওয়ার্ল্ড সিনেমা হিসেব করেই)। এই সিনেমাটার পেছনে এর কলাকুশলীরা ৬ বছর ধরে শ্রম দিয়েছে। আর সেই শ্রম স্পষ্ট সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে। তুম্বাড় মূলত প্রজন্মান্তরে চলে আসা লালসার গল্প বলেছে মিথিক অনুষঙ্গ নিয়ে। ভয়ের আড়ালে এখানে দর্শন উঁকি দেয়, দর্শনের আড়ালে রূপক। তুম্বাড় একটি পরিপূর্ণ সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স। এই সিনেমার সাউন্ড ডিজাইন, সিনেম্যাটোগ্রাফি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডেই অনবদ্য। বিশেষ করে সদা বৃষ্টিব্যস্ত তুম্বাড় গ্রামকে এতো সিক্ত, এতো মেঘলা আর এতো গা ছমছমে করা সম্ভব হয়েছে দারুণ ক্যামেরা ওয়ার্কের কারণেই। তুম্বাড়ের ভেতরের দৃশ্যগুলো দমবন্ধ করা, মহলের ভেতরের ধূলিধূসরতা যেন আবছা করে দেয় সব কিছু, বৃষ্টি দু-এক ফোঁটা মনে হয় শরীরেও এসে পড়ে। সব মিলিয়ে এ বছর বলিউডের সেরা সিনেমা আমার কাছে- তুম্বাড়।
এই সিনেমাগুলো ছাড়াও আরও বেশকিছু সিনেমা আছে যা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে পুরো বছরজুড়েই। এর মাঝে আছে- ১০২ নট আউট, পরমাণু, মান্টো, লায়লা মজনু, হিচকি, মুক্কাবাজ, মনমর্জিয়া, লাভ পার স্কয়ার ফুট, টাইগারস, বেয়ন্ড দ্য ক্লাউডস, পারি, ইত্যাদি। ভালো স্ক্রিপ্টের চাহিদা বাড়ছে বলিউডে, দর্শকরা ভালো গল্প দেখতে চাচ্ছে- এটা খুবই ভালো সাইন। সুপারস্টারদের নামে ভর করে চলা সস্তা গল্প দর্শক ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করছে না। সালমান, আমির, শাহ্রুখরা এখানেই পিছিয়ে পড়ছেন আর এগিয়ে যাচ্ছে আয়ুষ্মান, ভিকি কৌশল, রাজকুমাররা। এখনই সময় গল্পকে মর্যাদা দেয়ার, রাইটারদের এমপাওয়ার করার, তাহলে প্রতি বছরই ২০১৮ হয়ে নেমে আসবে বলিউডে। আরও অনেক সফলতা, আরও অনেক সুন্দর সুন্দর সব গল্প নিয়ে।
সেলিব্রেটিবিডি/এইচআর
Discussion about this post