মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে , লাশটা ফেলে দেয়া হয়েছে উঁচু কোন ভবনের ওপর থেকে। ভারী কিছু পতনের শব্দে ছুটে এসেছে লোকজন, আবিস্কার করেছে, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া একটা মৃতদেহ পড়ে আছে গলিতে। তারপর পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ছাপিয়ে লাশকাটা ঘরে ঠাঁই হলো মেয়েটার, ঘন্টাকয়েক আগেও হয়তো স্বপ্নাতুর চোখে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল যে! পরিচয় জানা গেল আরও খানিক পরে, রুবাইয়াত শারমীন রূম্পা নামের মেয়েটা পড়তো স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে, বাবা পুলিশ অফিসার। মা আর ভাইয়ের সঙ্গে শান্তিবাগের একটা বাসায় ভাড়া থাকতো সে। পুলিশ বলছে, ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে মৃতদেহের শরীরে।
হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়ার মতো একটা ঘটনা, মিডিয়াতে তোলপাড় পড়ে যাওয়া কথা ছিল। অথচ মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে এই ঘটনাটা ঠাঁই পেয়েছে ভীষণ অবহেলায়। বিখ্যাত কয়েকটা গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনে ঢুকলাম, সেখানে মিথিলা আর সৃজিতের বিয়ে নিয়ে দশ-বারোটা করে নিউজ। মিথিলা কি বলেছেন। কোত্থেকে শাড়ি কিনেছেন, মিথিলার বাবা-মা সৃজিতের জন্যে কী গিফট নিয়ে গিয়েছেন, বিয়ের পরে তারা কোথায় ঘুরতে যাবেন, সৃজিত মিথিলাকে উদ্দেশ্য করে ইন্সটাগ্রামে কোন ছবিটা আপলোড করেছেন, সেটার ক্যাপশনে কী লিখেছেন- অনলাইন মিডিয়া নেমেছে মিথিলাপিডিয়া হবার মিশনে!
সেখানে কোথাও রুম্পার ধর্ষিত হবার খবরটা জায়গা পায়নি সেভাবে, যতোটা সাড়া পড়ার কথা ছিল ন্যাক্কারজনক এই ঘটনাটাকে ঘিরে, যেভাবে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠার কথা ছিল সর্বস্তরে, সেরকম কিছুই হয়নি। ফেসবুকের নিউজফিড ভর্তি সেই একই জিনিসে, কেউ মিথিলা আর সৃজিতকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, বেশিরভাগই গালাগাল দিচ্ছে, ট্রল করছে। কলকাতার শিল্পী অনুপম রায় সৃজিতের বিয়ে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেখানে গিয়ে বীর বাঙালী গালি দিয়ে আসছে, অথচ রুম্পাকে নৃশংশভাবে হত্যা করা হলো, সেটা নিয়ে খুব বেশি মানুষের হেলদোল নেই! ফোকাসটা কখন কোথায় দিতে হয়, এটা আমরা কখনও বুঝে উঠতে পারিনি, বুঝতে পারবোও না হয়তো।
একদল উজবুক আবার এই মৃত্যুর ঘটনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে পর্দা বা শরীর ঢেকে রাখার দিকে, প্রতিবারই যেটা হয়। তাদের দাবী, রূম্পা হয়তো শালীন পোষাক পরেনি, তাই তার এই পরিণতি হয়েছে। মানুষের মতো দেখতে ছাগলগুলোর আচরণ দেখতে দেখতে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। ইচ্ছে করে রুম্পার খুনীদের সাথে এদেরকেও ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়ার দাবী জানাতে, সমাজ থেকে মুর্খ বিবেকহীন একদল মানুষ কমে গেলে লাভটা তো সমাজেরই।
মিডিয়া হচ্ছে একটা দেশের আয়নার মতো, সেখানে সমাজ আর দেশের চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে। পত্রিকাগুলো জানে কোন খবরটার কাটতি বেশি, কোন সংবাদে পাঠক আকৃষ্ট হবে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া তার স্বামীর গায়ে কুকুর ছেড়ে দেয়ার খবর যতোজন পড়ে, তার সিকিভাগও রুম্পাদের ধর্ষণ বা খুনের খবরে আগ্রহ দেখায় না। মিথিলার বিয়ের খবরে যে পরিমাণ কমেন্ট বা শেয়ার হয়, সেই অ্যাটেনশনটা রূম্পা, তনু কিংবা রূপারা মরে গিয়েও আদায় করতে পারেন না!
কয়েকদিন আগে ভারতের তেলেঙ্গানায় প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি নামের এক ভেটেরিনারি চিকিৎসককে ধর্ষণের পরে পুড়িয়ে মারা হলো নৃশংসভাবে, পুলিশের গাফেলতি ছিল সেই ঘটনায়। কিন্ত মিডিয়া অ্যাটেনশন পুরোপুরি ছিল ঘটনার প্রতি, কাজেই চাপে পড়ে একদিন পরেই গ্রেফতার করা হয় চার ধর্ষককে। ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে ২০১২-এর পর আরও একবার রাজপথে নেমেছে সাধারণ মানুষ।
প্রতিটা জায়গায় হাজির ছিল সাংবাদিকদের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, ভ্যান। ধর্ষিতার মায়ের বক্তব্য তারা যেমন নিয়েছে, তেমনই ছুটে গেছে ধর্ষকের বাড়িতেও। আন্দোলনকারী জনতার সঙ্গে তারা কথা বলেছে, মন্তব্য জানতে চেয়েছে তদন্তকারী পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন নেতাদেরও। আমাদের মিডিয়া সেই জায়গাটায় পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূরে।
এরই মাঝে ফেসবুকের নিউজফিডে অচেনা এক তরুণীকে চোখে পড়ে, মিডিয়ার এই আচরণের বিপরীতে গিয়ে তিনি গেয়ে উঠছেন- ‘গর্বের দেশে, ভাত জোটে ক্লেশে, কাজ পেতে লাগে দক্ষতা; ধর্ষিতা হতে লাগে না ডিগ্রি, বয়স, ধর্ম, যোগ্যতা…’ আমাদের বোধবুদ্ধি যে পুরোপুরি মরে যায়নি, কিছু মানুষের বিবেকবোধ এখনও জীবিত আছে, সেটারই যেন প্রমাণ দেন তারা। কিন্ত যারা বিবেকবোধের প্রমাণ দিলে কাজের কাজটা হতো, তারা তো দিবানিদ্রা দিয়েই কূল পাচ্ছেন না, কাজ আর করবেন কখন!
নিহত রুম্পার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন, তার মেয়েকে এই পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাটা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বুঝুন তাহলে! আমাদের অবশ্য কোন হেলদোল নেই তাতে। তনু মরুক, রূপা মরুক, বা রুম্পারা মরে শেষ হয়ে যাক, দিনশেষে নিজের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হলে আমাদের ঘুম ভাঙে না, আমাদের গায়ে লাগে না কিছুই। গণ্ডারের চামড়ার মতোই মোটে হয়ে গেছে আমাদের অনুভূতি, এসব হত্যা বা ধর্ষণ নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে বরং সৃজিতের ফেসবুক পোস্টে গিয়ে একটা মজার কমেন্ট করে আসা, কিংবা মিথিলাকে দুটো গালি দেয়াটাকেই বীরত্বের কাজ বলে মনে হয় আমাদের কাছে। জাতিগতভাবে নিজেরা তো দেউলিয়া হয়েই গেছি, প্রতিমূহুর্তে সেটার প্রমাণ দিতেও আমাদের কী ভীষণ আগ্রহ!
মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ
Discussion about this post