নজরুল ইসলাম টিপু , আবুধাবি : দীর্ঘ দিন তার ভিসা নেই, চাকুরী ও নেই তাই বেতন নেই। সমস্যাটা ওনার নিজের কারণে নয়। কোম্পানীর লাইসেন্মগত। ফলে স্বয়ং কোম্পানী বিদেশী মালীকের ও ভিসা নেই। মালীক জানিয়েছেন বিপদের দিনে সবাই কেটে পড়েছে, তুমিও চলে গেলে এই মরা কোম্পানী আর দাঁড় করানো সম্ভব হবেনা। সমস্যা সাময়িক ইনশায়াল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে ততদিন একটু সচেতন হয়ে চলো। তার এই সাময়িক সমস্যাও দুই বছরের বেশী সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখন আর ইচ্ছা করলেই দেশে ফিরে যাওয়া যাবেনা। মামলা হবে, আদালত ফায়সালা দিবে, তবেই সিদ্ধান্ত হবে। বাংলাদেশীদের ভিসা চালু নেই মূলত প্রবাসে বাংলাদেশীদের কোন অভিভাবক নেই। বরং বাংলাদেশে বসে সরকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে পিন মারার মানুষ আছে। কেউ একবার দেশে গেলে ফিরে আসার পথ নেই। জীবনে একবার প্রবাসী হলে, সারা জীবনে সে আর দেশে সুবিধা করতে পারেনা। প্রবাসের অগ্রগামী দক্ষতা দেশের পিছিয়ে পড়া কারিগরী ক্ষেত্রের কোথাও কাজে লাগাতে পারেনা। ফলে প্রবাসীর জীবন প্রবাসেই শেষ হয়।
সদা উৎফুল্ল মানুষটিকে চিনি দীর্ঘ বছর ধরে। তার যে জিনিষটি আমাকে বেশী আকর্ষন করে সেটা হল তার নির্মল হাসি।শিশুদের মত হাসতে হাসে তিনি তাদের সাথে সহজে মিশে যেতে পারেন। ফলে শিশুরাও তাকে বেজায় পছন্দ করে। কথা বলার ধরণ খুবই সুন্দর, কোন কথা ব্যাখা করার জন্য তিনি সামঞ্জস্য একটি ঘটনার উপমা তুলে আনতে পারেন। এটা তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। চাকুরী নাই, তাই বেতন নাই। বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহরে এভাবে বসবাস করা অনেক কঠিন। এই শহরের রাস্তায় কোট-টাই পড়া মানুষের চলাচল বেশী, দেখলে মনে হবে পৃথিবীর সকল সুখি মানুষ বুঝি এ শহরের বাসিন্দা! খবর নিতে গেলে বুঝা যায়, কমবেশী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে করুণ হাহাকার। চায়ের দোকানে চাকুরী করতে গেলেও সাহেবের মত বেশ ধারণ করা লাগে। কোথাও একজন মানুষের থাকার জায়গার একটি সিটের মূল্য বাংলাদেশের সেরা নগর জীবনের দুই বেড রুমের একটি বাসার এক মাসের ভাড়ার সমান! এই শহরে একটি হিসেবে কলা, মূলা, কমলা, আপেল, পেয়ারা, চা, রুটি, ড্রিংক্স, পেয়াজি সবার মূল্য প্রায় এক সমান। দেশের মানুষ কিভাবে বুঝবে এ শহরের মাসুল কত চড়া। তারা সহজ হিসেব বুঝে, যিনি আট হাজার টাকা সিট ভাড়া দেয় তার না জানি মাসিক বেতন কত? আর সে যদি মাসের শেষে যথাসময়ে টাকা দিতে দেরী করে, তাহলে বউয়ের কান কথার প্রভাব নয়তো, আর কি?
সদা আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করতে হয়। তিনি কারো কাছে হাত পাতার মানুষ নন। তার সুন্দর খাসিয়তের কারণে অনেকে সহানুভুতির হাত প্রসারিত করে। কেউ সাময়িক কাজ জুটিয়ে দেয়, শিক্ষিত মানুষটি কাজ বাছার মানুষ নন, যা পায় তাই করে খায়। এ ধরনের কাজ করা এদেশে চরম ঝুকিপূর্ন! দশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তারপরও পেটের দায়ে কাজ করতে হয়, কেননা দেশে তার পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র রয়েছে।
ঈদ উপলক্ষ্যে তিনি দেখা করতে এসেছিলেন; বললেন আজ তিনি শুধু আমার কথা শুনবেন! তিনি শুনাতেই মগ্ন কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছেন না। খেয়াল করলাম তিনি ঠোট চিপে ধরে কান্না করছেন। এই দৃশ্য তার সাথে বে মানান কেননা সদা হাসিমুখের এই চেহারায় চোখের পানি মিলছে না। প্রশ্ন করলাম, কি হয়েছে? কাদছেন কেন? তিনি বললেন, কষ্ট আর অপমানে। বহু বছর চোখের এই পানি ধরে রেখেছিলাম কিন্তু আর আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার হৃদয়ে অসহ্য কষ্ট, মনে প্রছণ্ড ব্যথা! এত বছর হাসতে দেখেছেন? সবই ছিল মিথ্যা, নিজের সাথে প্রতারণা করেছি মাত্র! কান্না লুকানোর কসরৎ করেছি।
তিনি বললেন,
আমার বাবা-মা বিশ্বাস করেনা যে, আমার চাকুরী নাই, আমি কষ্টে আছি। কবেতক পেটভরে ভাত খেয়েছি মনে করতে পারিনা। এসবের কিছুই বিশ্বাস করেনা! যতই কষ্টের কথা বলি, যেভাবে বুঝাই, তারা তার পুত্রকে বিশ্বাস করেনা। তাদের বিশ্বাস স্ত্রীকে সুখে রাখার জন্যই আমি টাকা লুকাই। অথচ আমার স্ত্রীও তাদের সাথে থাকে! এই অন্ধ সন্দেহের কারণে স্ত্রীকে এক মুহূর্তের জন্যও সুখ দেয়না। সর্বদা খোটা, টিপ্পনীর উপর অতিষ্ট করে রাখে। বউকে শান্তনা দেবার জন্য কর্জ করেই ফোন করি। মা-বাবা ভাবেন কোন চক্রান্ত করছি। মা-বাবাকে হিসেব কষে চলতে বললে, ফোনেই বকাবকি শুরু করে। তিনি চায়ের দোকানে বসে, আমারই পাঠানো টাকা দিয়ে তার বন্ধুদের চা খাইয়ে, জোর করে আমার বদনাম শুনায়!
আমার দু’মাসের খানার বিল বাকি, একটি প্যান্ট ও এক শার্টে থাকি। রোজার আগে বহু জন থেকে ধার-কর্জ করে বাবার জন্য পয়ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। এই টাকা পেয়ে তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন! তিনি সমানে চিল্লাচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে তিনি কিভাবে রোজার মাস চলবেন। পুরো গ্রাম তিনি মাথায় তুলছেন। অথচ গ্রামীণ জীবনে রোজা পার করার জন্য এই টাকা যথেষ্ট।
বাবাকে ফোন করে জানালাম, বাবা তুমি কেন মানুষদের সামনে ঘরের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছ? আমাকে কটু কথা শুনাচ্ছ? আমাকে তো সবাই ভাল জানে। জন সমাজে আমার সমালোচনা করলে কি তোমার ইজ্জত-সম্মান বাড়বে?
এই কথা বাবার ইজ্জতে লাগে। তিনি বললেন, সামান্য টাকা দিয়ে ফকিরের মত জীবন চালাবার পরামর্শ দাও, আবার নিজের ইজ্জত মারাও! বাজে কথা বলে বকতে রইলেন। বাবার এই বকাও আমি কর্জের টাকা দিয়ে কষ্ট করে সহ্য করছিলাম, মনে হচ্ছিল মগজ ফেটে যাবে। তার গোস্বা যাতে আর না বাড়ে সে জন্য ফোনের লাইন না কেটে ধৈর্য ধরে শুনছিলাম।
না, তিনি আরো কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ বিকেলেই বাজারে মাইক লাগিয়ে তিনি মানুষকে আমার ইজ্জত সর্ম্পকে বিষদ জানাবেন। আর বাড়ী থেকে আমার স্ত্রী-পুত্রকে বের করে দিবেন। হ্যা, তিনি শেষের কাজটি ইতিমধ্যে সেড়েছেন, বউ তার বাপের বাড়ীতে….
Discussion about this post