তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ফাতিহ শহরের প্রাচীন খিরকা শরিফ মসজিদে সংরক্ষিত আছে সপ্তম শতাব্দীর একটি জুব্বা, যা রক্ষণাবেক্ষণ করছে একটি পরিবার। ধারণা করা হয়, জুব্বাটি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এবং সংরক্ষক পরিবারটি বিখ্যাত সুফি ওয়ায়েজ আল কারনি (রহ.)-এর বংশধর। রমজানে সাধারণ মানুষের প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করা হয় জুব্বাটি, যা দেখতে আসে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ।
খিরকা শব্দের অর্থ জুব্বা বা জামা। মূলত সংরক্ষিত জুব্বার জন্যই ১৬০ বছরের পুরনো এই মসজিদের নাম মসজিদে খিরকা শরিফ রাখা হয়েছে। অষ্টকোণ আকৃতিতে তৈরি মসজিদটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন মূল প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশ না করেই দর্শনার্থীরা জুব্বাটি দেখতে পারে।
খিরকা শরিফ মসজিদ ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি সুমেরা গুলদাল বলেন, ‘মাত্র তিন সপ্তাহে আমরা তুরস্কের অন্যান্য জাদুঘরের চেয়ে অনেক বেশি দর্শনার্থী পাই।’ সুমেরা গুলদাল নিজেও হজরত ওয়ায়েজ কারনির বংশধর হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁদের দাবি, ওয়ায়েজ কারনি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমসাময়িক। তাঁদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়নি, তবে বিশেষ কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে এই জামা উপহার দেন। প্রায় ১৩০০ বছর ধরে তাদের পরিবার পরম যত্নে মহামূল্য ঐতিহাসিক এই স্মারকটি সংরক্ষণ করছে। ওয়ায়েজ কারনি (রহ.)-এর ৫৯তম বংশধর বারিস সামির বলেন, ‘শৈশব থেকে আমি এই মসজিদে রয়েছি। আমি দেখেছি, জুব্বাটির প্রতি আমার পরিবার কতটা দায়িত্ববান। তবে তাঁরা অত্যন্ত নিঃসংকোচেই সাধারণ মানুষকে তা দেখতে দেন।
ওয়ায়েজ ইবনে আমির ইবনে হারব আল কারনি (জন্ম ৫৯৪ খ্রি.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমসাময়িক, তবে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। কথিত আছে, ওয়ায়েজ কারনি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মদিনায় যান; কিন্তু মায়ের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে দেখা না করেই ফিরে যান। এই সংবাদ পেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে নিজের জামা দান করেন। ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, ওয়ায়েজ কারনি (রহ.) সিফফিনের যুদ্ধে আলী (রা.)-এর পক্ষে অংশগ্রহণ করেন।
তাঁর পরিবার অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত ইরাকে বসবাস করত। পরে তাদের ইরাক ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারা ইরাক থেকে এসে তুরস্কের পশ্চিম আনাতোলিয়ায় বসবাস শুরু করে। এরপর তারা আজিয়ান সাগরের তীরবর্তী কুসাদাসি শহরে নিজস্ব আবাস গড়ে তোলে। তবে সামির বলেন, ‘আমরা কেন কুসাদাসি এসেছিলাম এবং এখানে বসতি গড়েছিলাম তার পক্ষে কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই। সম্ভবত উমাইয়া খলিফাদের থেকে নিরাপদ থাকার জন্য তাঁরা এখানে এসেছিলেন। আর আমাদের পরিবার ইস্তাম্বুলে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বসবাস করছে।’
তিনি আরো বলেন, ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় খলিফা প্রথম আহমদ জুব্বাটি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তা কবজা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু খলিফার উপদেষ্টারা তাঁকে এই বলে সতর্ক করেন যে এ কাজ হয়তো মুহাম্মদ (সা.)-এর ইচ্ছাবিরোধী হবে; বরং আমরা পরিবারটিকে ইস্তাম্বুলে আমন্ত্রণ করতে পারি। সেই থেকে পরিবারটি ইস্তাম্বুলে বসবাস করছে এবং তারা প্রতি রমজানে সাধারণ মানুষের জন্য সংরক্ষিত জুব্বাটি উন্মুক্ত করে দেয়।
আঠারো শতকে উসমানীয় শাসক সুলতান আবদুল হামিদ ফাতিহ শহরে জুব্বা সংরক্ষণের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় সুলতান একটি মসজিদ এবং জুব্বা রাখার জন্য অষ্টকোণ একটি ঘর নির্মাণ করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সেখানেই জুব্বাটি রয়েছে।
উল্লেখ্য, ওয়ায়েজ কারনি (রহ.)-এর বর্ণিত ঘটনা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ এ ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সুত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ (অনলাইন) ৩ জুন ২০১৯
Discussion about this post