শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ত্রাস ছড়ানো নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের করা নির্যাতন নিয়ে মুখ খুলছেন অনেকেই। আজ তাদেরিই একজনের ফেসবুক পোস্ট আমিরাত সংবাদের পাঠকের কাছে তুলে ধরা হলো।
কালকে থেকে আমাদের মিছিলে আসবি আর নইলে তোর বাপ মাকে বলে দিস, পলিটেকনিকে যে কোন জায়গা থেকে লাশ টা খুঁজে নিয়ে যেতে! আর এক সপ্তাহের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা আমার সাথে দেখা করে দিয়ে যাবি, নইলে পলিটেকনিকে কিন্তু পড়তে পারবি না।
সাল 2014 এর ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে, রাজশাহী পলিটেকনিকের মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ শেষে পলিটেকনিকের গেটের দিকে যাচ্ছিলাম বাসায় ফিরব বলে, কিন্তু রেজিস্টার শাখার সামনে আম গাছের নিচে তিনজন মানুষ আমাকে পথ আটকে ধরল। নাম পরিচয়সহ কোন সেমিস্টারে পড়ি সেটা জানতে চাইলে বলার পরে তারা আমাকে বলল “তুই শিবির করিস!” তোরে পুলিশে দিয়ে দিব। আমি বলি, না ভাইয়া আমি কোন দলের সাথে সংযুক্ত না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে আমাকে বাসায় ঢুকতে দিবে না এবং আমাদের বাসাতে এটাই রুলস।
সে বলে পলিটেকনিকে গিয়ে পড়তে চাস এবং বেঁচে থাকতে যদি চাস তাহলে কালকে থেকে আমাদের মিছিলে আসবি আর নইলে তোর বাপ মাকে বলে দিস, পলিটেকনিকে যে কোন জায়গা থেকে লাশ টা খুঁজে নিয়ে যেতে! আর এক সপ্তাহের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা আমার সাথে দেখা করে দিয়ে যাবি, নইলে পলিটেকনিকে কিন্তু পড়তে পারবি না।
অনেক ভীত হয়ে অনেক রিকোয়েস্ট করে বললাম যে ভাইয়া আমার পড়াশোনায় করাইতে পারছে না বাসা থেকে, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে বৃত্তি পেয়েছি সেটা টাকা দিয়েই পড়াশোনা করছি। আমার বাবা-মা কখনোই আমাকে ৪০ হাজার টাকা দিতে পারবে না। তাই দয়া করে আমার পড়াশোনাটা বন্ধ করে দিবেন না প্লিজ! তখন তারা বলে, তাহলে তুই নামাজ পড়বি না, আমাদের মিছিলে প্রতিদিন যাবি তাহলেই হবে।
আমি সেদিন থেকে নামাজ পড়তে মন চাইলেও নামাজ পড়া ত্যাগ করলাম। তারা প্রতিনিয়ত ফলো করতো। বাসা থেকে প্রতিনিয়ত যাওয়া আসা করি খুব কষ্ট হয়। এক মাস পরে শিরোইল কলোনিতে একটা মেসে উঠি। সেখানে রায়হান, রিপন নামের নিউ গভঃ ডিগ্রী কলেজে ছাত্রলীগ করত। পলিটেকনিকে আমাকে যারা হুমকি দিয়েছিল তার মধ্যে বেলাল নামের এক নেতা ছিল সে আমার মেসের তাদেরকে ম্যানেজ করে কয়েক মাস পরেই আমাদের মেসে আসা যাওয়া করতে শুরু করলো এবং ছাত্রলীগের ওই ভাইয়াদের রুমে নেশা করত।
দেখা হলে বারবার বলতো তুই টাকাটা এখনো দিলি না! তোর কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, যেভাবেই হোক টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা কর! তুই ছোট মানুষ, মাথায় রাগ উঠাইস না।
একদিন বৃহস্পতিবার রাত দশটার ট্রেনে গ্রামে গিয়েছি মায়ের হোটেলের অতিথি হয়ে। ফিরে এসে আমার রুমের তালা খুলে দেখি, আমার ট্রাংকের তালাটা ভাঙ্গা এবং ট্রাঙ্কের ভিতরে এডমিট কার্ড এবং রেজিস্ট্রেশন কার্ড নাই। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম যে এটা কিভাবে সম্ভব আমার রুমের তালা ঠিক আছে কিন্তু ট্র্যাংকের তালা ভেঙে এডমিট কার্ড রেজিস্ট্রেশন কার্ড নাই! মেসের অন্য মেম্বারদেরকে বললে তারা বলে আমরা কি জানি!
তুমিতো তালা মেরে দিয়ে গেছো তোমার রুমের তালা তো ঠিকই আছে, তুমি তো নিজেই রুমে তালা ফেলে ঢুকলা। তুমি হয়তো মিথ্যা কথা বলে আমাদের সাথে নাটক করতেছ!
পরবর্তীতে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের আমাদের সাথেই একজন ওই মেসে থাকতেন, তাকে একজন ভয় দেখাইলাম যে তুই মেসেই ছিলি , অন্য কোথাও যাসনি ওই কয়েকদিনের মধ্যে। তাই আমার রুমে কে ঢুকেছিল তুই বল, নইলে তোর ঝামেলা হবে! সামনে আমার পরীক্ষা দিতে পারবো না। তুই সব জানিস, তুই বল!
পরবর্তীতে সে আমাকে বলে তোর রুমের তালা মেকারকে দিয়ে খুলিয়ে বেলাল ভাইয়েরা রুমে ঢুকেছিল, এখন ভাইয়েরাই নিয়ে গেছে কিনা জানি না। এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমার চাচাতো ইলিয়াস ভাইয়াকে কল দেই, কারণ উনি শিরোইল কলোনিতেই থাকতেন। সে তার বন্ধুবান্ধব সকলকে ম্যানেজ করে যে নেতাদের কাছে আইডি কার্ড রেজিস্ট্রেশন কার্ড আছে, তাদেরকে কৌশলে ডাক দিয়ে ইমিডিয়েটলি থ্রেট দিয়ে এডমিট কার্ড এবং রেজিস্ট্রেশন কার্ড উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে জীবনের এক বড় টেনশন থেকে মুক্তি পাই।
এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত পাওয়ার জন্য পরবর্তীতে রোভার স্কাউটিং এ যুক্ত হই, কারণ আমি রাজনীতি পছন্দ করি না এবং স্কাউটিং অরাজনৈতিক সংগঠন। স্কাউটিং এর সাথেই একটু বেশি সময় দেওয়া শুরু হলো কিন্তু ছাত্রলীগের ওই সদস্য গুলো আমাকে কিছু না বললেও পরবর্তীতে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হলে স্যারদের মাধ্যমে শিবিরের তকমা দেওয়ার চেষ্টা করা হত।
এমনও হয়েছে, আমার স্কাউট লিডার সারওয়ার স্যার আমাকে কল দিয়ে বলেছেন, রহমত তুমি ক্যাম্পাসের আশেপাশেও আসবে না। তোমার কিছু হলে আমি কোন দায়িত্ব নিতে পারব না। তুমি স্কাউটিং কর, তোমাকে আমি স্নেহ করি কিন্তু আমি যতদিন না বলবো ততদিন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আসবে না। তোমাকে যে কোন সময় শিবির বলে পুলিশে দিতে পারে।
কোনদিন কোন রাজনীতি করিনি, করতেও চাই না। কিন্তু নামাজ পড়ার কারণে আমাকে পলিটেকনিকের পাশ করা পর্যন্ত এই শিবিরের তকমা এর ভয় পেয়ে বেড়াতে হয়েছে। পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার আগে কখনো এক ওয়াক্ত নামাজ মিস হয়নি। নামাজ মিশ হলে বাসায় থাকতে দিত না, খাবার খেতে দিত না, এই ভয়ে হলেও শীতকালে কষ্ট করে নামাজ পড়তাম। বাসার কঠোর নিয়মের জন্য নামাজের প্রতি ভালোবাসা মন থেকেই জন্মে গিয়েছিল।
কিন্তু আমাকে বাধ্য হতে হয়েছিল নামাজ ত্যাগ করতে! যদি এই বিষয়টা বাসাতে জানাতাম, আমার পড়াশোনা সেখানেই স্টপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন মনে হয় স্টপ হয়ে গেলেই মনে হয় ভাল ছিল! অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সহজ সরল জীবন যাপন করতে পারতাম!
দশ বছর হতে যাচ্ছে, টানা এক সপ্তাহ কোনদিন নামাজ পড়তে পারিনি! আমি যে এমন মীরজাফর হয়ে গেছি, কিভাবে আমি আগের মত হবো! আমার বাবা-মা যখন এখনো কল দিয়ে বলে, আমার কিচ্ছু দরকার নাই!
প্রয়োজনে তুই বাসায় চলে আয়, আমার চোখের সামনে নামাজ রোজা করবি, লবণ ভাত খেয়ে আমার ছেলে আল্লাহর পথে থাকবে, এটাই আমার চাওয়া। কিন্তু বাবা মায়ের চাওয়া পাওয়াটা কবে যে শতভাগ পূরণ করতে পারব, আল্লাহই ভাল জানেন!
ছাত্রলীগ! আমার পরিবারে বেনামাজি তকমা পাওয়ার একমাত্র কারণ তুমিই!
রহমত আলী, রাজশাহী
Discussion about this post