বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দামে রেকর্ড পতন হয়েছে। ২০২১ সালের পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে নেমেছে। অনেকের আশঙ্কা, তেলের দাম ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে।
আজ বুধবার সকালে বিশ্ববাজারে ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৬৭ দশমিক ৬৮ ডলার। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দামও কমেছে, যদিও তা এখনো ৭০ ডলারের নিচে নামেনি। প্রতিবেদন লেখার সময় এই তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৭১ দশমিক ০৫ ডলার। অয়েল প্রাইস ডটকম ও রয়টার্স সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত এপ্রিল মাসেও বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার জেরে তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন, তেলের দাম আবারও প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারে চাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টো ঘটনা, দাম কমে ৭০ ডলারের নিচে নেমে এল।
বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে দাম কমছে। যতই সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা থাকুক, দিন শেষে বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে চীন। তাদের চাহিদার ওপর বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেকটা নির্ভর করে। কিন্তু সেই চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। সেখানে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় তেলের বাজারে মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। বছরের প্রথম ভাগে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনের তেল আমদানি কমেছে। চাহিদা কম থাকায় তেল খুব একটা মজুত করছে না চীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দাম কমার এটাই মূল কারণ।
কোভিড মহামারির সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের চাহিদা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২০ ডলারে নেমে এসেছিল। এরপর তেলের দাম বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২০২২ সালের অক্টোবর মাসেই তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারে নেমে আসে। তার পর থেকে তেলের দাম এর আশপাশেই ছিল। কিন্তু চলতি মাসে দাম আরও কমে গিয়ে ৭০ ডলারের নিচে নেমে গেল।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের আশঙ্কা, ২০২৪-২৫ সালে তেলের চাহিদা আরও কমতে পারে। ওপেকের তথ্য বলছে, এখন দৈনিক চাহিদা ১৭ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল হলেও চাহিদা কমে ১৭ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেলে নেমে আসতে পারে।
অ্যাঙ্গোলা, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, লিবিয়া, সৌদি আরব, গ্যাবন, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি—এই ১২ দেশ নিয়ে গঠিত জোট ওপেকের ওপর মূলত নির্ভর করে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কতটা বাড়বে বা কমবে।
চাহিদা কমলেই ওপেক অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস করে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা তেলের উৎপাদন হ্রাস করেও বাজারে দাম খুব একটা বাড়াতে পারেনি। তবে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো আগামী বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়াতে পারে বলে জানা গেছে। এশিয়া-প্যাসিফিক পেট্রোলিয়াম কনফারেন্সে (এপিপিইসি) এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটসের গবেষণা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম বুরখার্ড এ কথা বলেছেন।
ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তেলের দাম ৭০ ডলারের নিচে নেমে যাওয়ায় তারা উত্তোলন বৃদ্ধির সময়সীমা দুই মাস পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওপেক প্লাস জানায়, প্রয়োজনে তারা উত্তোলন কমানো বা অন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এপিপিইসিতে বহুজাতিক কোম্পানি ট্রাফিগুরার তেল বিভাগের প্রধান বেন লাকক বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে জ্বালানি তেলের বাজারে রীতিমতো উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শিগগির বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে। এমনকি ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো উত্তোলন না বাড়ালেও বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হয়ে যেতে পারে।
Discussion about this post