সম্প্রতি দুবাইয়ে একটি স্টার অ্যাওয়ার্ড শো অনুষ্ঠানে ডাকা হলো দেশের খ্যাতিমান বেশ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। উদ্দেশ্য জমকালো আয়োজন করে তাদের সম্মানিত করা হবে। আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা এসেছেন দেশ থেকেই। এরআগে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে দুই দফায় সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ২০ জন তারকা শিল্পী এতে অংশ নিবেন। কিন্তু অনুষ্ঠান স্থলে দেখা গেল সেই তালিকায় থাকা জায়েদ খান সহ মাত্র আটজন উপস্থিত হয়েছেন। তাও নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার ঘন্টা পর মঞ্চে ওঠেন তারা। কোন রূপ পারফর্ম ছাড়াই সম্মাননা নিয়ে ঘন্টা দেড়েকে হলও ছাড়লেন তারকারা। এটি টুকে রাখা তথ্য। এতটুকু ঠিক ছিল। বিপত্তি দেখা দিল ওই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকদের হাতে ‘অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দিতে গিয়ে। মঞ্চ থেকেই জোরেশোরে চেঁচিয়ে উঠলেন এক নারী। প্রাপ্ত অ্যাওয়ার্ড ছুড়ে পেলে ভেঙে ফেলার হুমকিও দিলেন। সহজে বুঝা যাচ্ছে তিনি অসন্তুষ্ট।
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার- দেশ বিদেশে এমন যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে আয়োজকরা স্বাভাবিকভাবে পৃষ্ঠপোষকদের ধারস্থ হন। অর্থের লেনদেনের বিনিময়ে মঞ্চে তাদের সম্মানিত করেন। এখানেও তাই। ওই নারীর বাকবিতণ্ডায় বুঝা গেল, ভারী অর্থের লেনদেন হলেও তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি। কথা হচ্ছে- তাই বলে মঞ্চেই উত্তেজিত হতে হবে কেন? অবশ্যই তার এমন উত্তেজনায় একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসে গেছে- যারা এই অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছেন এবং যিনি এটি গ্রহণ করছেন দুই পক্ষের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে! পরে জানা গেল, আয়োজকদের আচারণে, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খল অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য ওই অনুষ্ঠানের প্রায় সকল পৃষ্ঠপোষক তাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে শিল্পীদের দীর্ঘ তালিকা দেখিয়ে প্রলুপ্ত করার অভিযোগ ছিল গুরুতর।
আলোচনা আরো দীর্ঘ করব। তার আগে একটু পেছনে যেতে চাই।
চলতি বছরের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিয়েল হিরোস অ্যাওয়ার্ড’ নামে এমন একটি শো থেকেই মূলত বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। দেশটিতে দশ লাখের অধিক বাংলাদেশির বসবাস। সেই হিসেবে তাদের বিনোদনের চাহিদা থাকায় এর আগে-পরে এমন আচার-অনুষ্ঠান আরো হয়েছে। তবে ওই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাও দেশ থেকে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চলচ্চিত্রের সুপারস্টার শাকিব খান। ওই অনুষ্ঠানে যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে ক’টি অ্যাওয়ার্ড উঠেছে তার চেয়েও জনে জনে প্রশ্ন রেখেছিলেন- সম্মাননা কার হাতে তুলে দেওয়া হলো ? কিংবা আয়োজকের চেনাজানা বা পরিচিতের হাতেইবা কেন রিয়েল হিরোস অ্যাওয়ার্ড ? এসব প্রশ্নের চেয়েও বাতাস ভারী হয়েছে ভিন্ন প্রসঙ্গে। অনুষ্ঠান ঘিরে আমিরাতের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছিল। অনেকেই অভিযোগ করেন, ওই আয়োজনে মূলত টাকার বিনিময়ে অ্যাওয়ার্ড বিক্রি করা হয়েছে।
বছর পাঁচেক আগে কথা। বিদেশে অনুষ্ঠানের নামে মানবপাচারের অভিযোগ উঠেছিল বাংলাদেশি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার নামে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ‘বাংলাদেশি নাইট’ নামে ওই সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন এক ঝাঁক তারকা। সেসময় ওই পরিচালক সহ আরো ৫৭ জন বাংলাদেশিকে প্রায় সপ্তাহখানেক আটক রাখে মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা পুলিশ। বিব্রতকর এমন ঘটনায় দেশের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কঠোর হবার ঘোষণা দিয়েছিল। সেসময় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর এই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছিলেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তারকাদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
আবার ফেরা যাক প্রসঙ্গে। দেশ থেকে তারকা নিয়ে বিদেশে এমন আয়োজন করা অপরাধ নয়। বরং বৃহত্তর প্রবাসী কমিউনিটির বিনোদনের অংশীদার হতে পারেন তারকারা। কিন্তু এর আড়ালে প্রতারণা, অর্থের বিনিময়ে অ্যাওয়ার্ড বাণিজ্য কিংবা মানবপাচার গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনরা। বেশির ভাগের অভিযোগ, এমন আয়োজনের পেছনে তিনটি উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক. সম্মাননার নামে বাণিজ্য কিংবা স্বল্প দামে কেনা ক্রেস্টের বিনিময়ে অধিক অর্থ আয়। দুই. সাংস্কৃতিক আয়োজনের নামে মানবপাচার। তিন. কালো টাকা সাদা করা। সঙ্গত কারণে, এটি এখন একেবারেই স্পষ্ট। তবে সেদিকে যাব না। এরজন্য আইন আছে, আইনের প্রয়োগ আছে। বরং সচেতনতা নিয়ে কথা বলা যাক। কারণ, ব্যক্তি ও সমষ্টিগত সচেতনতাই এমন প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে আমাদের।
আলোচনা হতে পারে- পুরস্কার ও সম্মাননা নিয়ে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের বিশেষ ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া হয়। আর সম্মাননা হচ্ছে সম্মানসূচক পদক। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির দীর্ঘ সাফল্যের জন্য যেমন সম্মাননা দেওয়া যায়, তেমনি এধরনের আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যেও সম্মাননা দেওয়া যেতে পারে। বড় কথা হচ্ছে- এই সম্মাননা কারা দিচ্ছেন এই বিষয়টিতে যেমন গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন, তেমনি যিনি এটি পাচ্ছেন তারও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু সেই বিষয়টিও যাচাই করা প্রয়োজন। অন্যথায় এই সম্মাননার ঔজ্জল্য বা ভার কমে যায়।
দেশে জাতীয় পুরস্কার ও পদক প্রথাটি স্বাধীনতার পরেই তৈরি হয়েছে। সর্বাধিক স্বীকৃত নাগরিক পুরস্কার হলো একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। যা প্রতিবছর দেওয়া হয়। শিক্ষা, কলা, সিভিল সার্ভিস বা সমাজসেবা এবং মুক্তিযুদ্ধের মতো ক্ষেত্রে বিস্তৃত কৃতিত্বের জন্য পুরস্কারগুলো মূলত বেসামরিক পুরস্কার। কখনো কখনো এসব পুরস্কার মরণোত্তর হিসেবেও প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও রয়েছে আরো বেশকিছু খেতাব, পুরস্কার। এতে একজন ব্যক্তির দীর্ঘ সফলতাকে মূল্যয়ন করা হয়। কালক্রমে একটি জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। একসময় সম্মাননা প্রদানের শুরু হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনেও। তবে সম্মাননার জায়গায় ‘অ্যাওয়ার্ড’ শব্দের বহু ব্যবহার এটিকে দিনকে দিন বিতর্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
মজার বিষয় হচ্ছে- এখন যেখানে সেখানে যেকেউ সম্মাননা পাচ্ছেন, দিচ্ছেন, নিচ্ছেন। এই যেন বাজারে বিক্রিত মাল। সম্মান দেখানোর এই বাণিজ্যিক প্রথা চালু হবার কারণে ‘অ্যাওয়ার্ড’ তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। মান কমছে সম্মানের। ক্ষেত্র বিশেষে সম্মান পাবার যোগ্য ব্যক্তিও বাদ পড়ছেন। আবার বিপরীতে মঞ্চে সম্মাননা গ্রহণ করছেন অর্থবিত্তের অধিকারী সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তি। কখনও কখনও দেখা যায়, মানবাধিকার লংঘনের দায়ে অভিযুক্ত কেউ দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলছেন সম্মাননা হাতে।
তাহলে করণীয় কী ? প্রথমত কথা হচ্ছে- অ্যাওয়ার্ড বা সম্মাননা কারা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য কী? এসব খতিয়ে দেখা। অর্থায়নের আগেই কয়েকবার চিন্তা করা। আর যারা সঠিক পন্থায় এসব আয়োজন করবেন, তাদের ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে হবে ব্যক্তির অতীত কর্মকাণ্ড, সামাজিক অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা। এক্ষেত্রে দুটি ভাগ করা যেতে পারে। যেহেতু বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক ব্যতিত এমন আয়োজন অসম্ভব। তাই পৃষ্ঠপোষক এবং ওই সম্মাননা প্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে একটি প্রকৃতিগত পার্থক্য নিয়ে আসতে হবে। যাতে দুই পক্ষের সম্মান ঠিক রেখে সম্মাননা দেওয়া যায়।
তবে শেষ কথা হচ্ছে- সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে যাচাই বাছাই করতে হবে ব্যক্তির সামাজিক কর্মকাণ্ড। প্রবাসীরাও এধরণের আয়োজনে অর্থায়নের আগে ভাবতে হবে আরো কয়েকবার। আর যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো সংস্থা বা সংগঠন থেকে সম্মাননা নিতে যাচ্ছেন তাদেরকে সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে সম্মান দেখানোর চেয়ে সমাজের এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে অ্যাওয়ার্ড বিক্রেতা।
কামরুল হাসান জনি
লেখক ও সাংবাদিক
Discussion about this post