রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থায় যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তাতে দিনদিনই ডলারবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে অনেক দেশ বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। এমনকি ব্রিকস জোটে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে আরো ২৫টি দেশ। এতে ব্রিকসের সদস্যসংখ্যা বেড়ে হবে ৩০।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দেশগুলো যদি ডলারের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করে তবে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় আরেকটি শক্তিশালী মুদ্রার উত্থান ঘটবে, যা ডলারকে টলিয়ে দিতে পারে।
পরবর্তী ব্রিকস সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় থাকবে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি। আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো নিজেদের বাণিজ্যিক পরিশোধ কিভাবে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় করবে, এ নিয়ে আলোচনা করা হবে। ফলে শুধু বেইজিং আর মস্কো নয়, ভারত থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন ডলারমুক্তকরণে ঝুঁকছে।
বর্তমানে ব্রিকস সদস্য দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ বছরই জোটটি সম্প্রসারিত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জোটে আরো দেশের যোগদানের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিও আগস্টের সম্মেলনে আলোচনা করা হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এক ডজনেরও বেশি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
অর্থনীতিবিষয়ক অনলাইন ওয়াচার গুরুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নতুন মুদ্রা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। যে দেশগুলো ব্রিকস জোটে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে সেগুলো হলো আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বেলারুশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সেনেগাল, সুদান, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া, তুরস্ক, উরুগুয়ে, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে।
নতুন সদস্য মিলিয়ে ৩০ দেশ যদি ডলার ত্যাগ করে এবং একটি নতুন মুদ্রা দিয়ে আন্ত সীমান্ত লেনদেন শুরু করে, তবে তা হবে মার্কিন ডালারের ওপর একটি বড় প্রত্যাঘাত। এতে বিশ্বব্যাপী দুর্বল হতে পারে ডলার এবং এর ঘাটতি পুনরুদ্ধার করার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শিগগিরই প্রকাশিত হতে যাওয়া ‘ব্রিকস মুদ্রা’ আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যে দেশগুলো ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তারাও তেলসমৃদ্ধ দেশ। সুতরাং এই জোট ইউরোপীয় দেশগুলোকে তেলের জন্য নতুন মুদ্রা দিয়ে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করতে পারে, ডলার নয়। আর তা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খাতের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলার শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বিশেষত রাশিয়া ও চীন এই মুদ্রা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন থেকে চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক এই চেষ্টায় অন্যান্য দেশও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের জুলিয়াস সেন বলেন, ‘ডলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে যে দেশ টার্গেটে পরিণত হয় সেই দেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এটি সবার জন্যই ক্ষতিকর।’
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন বাড়ছে। ব্লুমবার্গের গত ফেব্রুয়ারির তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, রাশিয়ার বাণিজ্যে প্রথমবারের মতো ডলারকে ছাড়িয়েছে চীনের ইউয়ান। এমনকি চীন-রাশিয়ার বাণিজ্যের ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে এখন স্থানীয় মুদ্রায়।
অনেক দেশই এখন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিকল্প ইউয়ানসহ অন্যান্য মুদ্রাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও ডলারের অবস্থান ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রার ৭০ শতাংশ ছিল ডলার, এখন তা কমে ৬০ শতাংশের নিচে নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রার ৫৮.৩৬ শতাংশ ছিল ডলার। ২০.৪৭ শতাংশ ছিল ইউরো, ৫.৫১ শতাংশ জাপানি ইয়েন, ৪.৯৫ শতাংশ পাউন্ড স্টার্লিং, ২.৬৯ শতাংশ চীনা ইউয়ান, ২.৩৮ শতাংশ কানাডিয়ান ডলার, ১.৯৬ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ০.২৩ শতাংশ সুইস ফ্রাঁ এবং ৩.৪৫ শতাংশ অন্যান্য মুদ্রা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে পরিমাণ ঋণ দাঁড়িয়েছে তাতে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেকোনো সময় আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ অবস্থায় অনেক দেশই আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ডলারমুক্ত লেনদেনে ঝুঁকছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করেছে তার চেয়ে ৭২৩ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করেছে। ফলে দেশটির রাজস্ব ঘাটতি আরো বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জাতীয় ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩১.৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার। যা বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ বলে অর্থনীতিবিদরাই বলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে দেশটির ডেপুটি ট্রেজারি সেক্রেটারি সিএনএন সানডে টক শোতে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কংগ্রেস ঋণসীমা বাড়াতে ব্যর্থ হয় তবে আমরা ঋণখেলাপি হবো, পরিণতিতে মন্দায় নিপতিত হবো এবং এটি হবে বিপর্যয়কর।’ এ বিপর্যয় বিশ্ব অর্থনীতিকেও টালমাটাল করে তুলবে।
বিকল্প মুদ্রা বিষয়ে জাপানের কিইও ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিষয়ক অধ্যাপক মাসায়া সাকুরাগাওয়া বলেন, ‘ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন মুদ্রার প্রাধান্যের যে প্রবণতা তা বদলে গেছে একটি বড় যুদ্ধের পর। যেমন ডলার বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে অবস্থান তৈরি করেছে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপকে সহযোগিতা করেছে। একইভাবে যুদ্ধের পর চীনও রাশিয়াকে সহযোগিতার মাধ্যমে ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে পারে।’ সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড, ওয়াচার গুরু, আলজাজিরা।
Discussion about this post