ছোট বেলায় আমরা বাংলায় একটি প্রবাদ শুনেছিলাম,”দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ”। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতাই সফলতার মূল। আর ইসলামে ঐক্যবদ্ধতা বা একতা অত্যাবশ্যকিয় হিসেবে ধরা হয়।
তাওহিদের পরে মুমিনদেরকে যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা হলো- ঐক্য। এ সর্ম্পকে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধর (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ’ -সূরা আল ইমরান: ১০৩
ঐক্য প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমের আরও কিছু আয়াত হলো-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, সালাত কায়েম কর এবং কখনো মুশরিকদের দলভূক্ত হয়ো না, যারা তাদের দ্বীনকে টুকরো করে দিয়েছে এবং নিজেরা নানা দলে বিভক্ত হয়েছে, এদের প্রত্যেকটি দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়েই মত্ত। ’ -সূরা তাওবা: ৩১-৩২
‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। ’ -সূরা হুজরাত: ১০
‘এই যে তোমাদের জাতি, এতো একই জাতি, আর আমি তোমাদের পালনকর্তা, অতএব তোমরা (ঐক্যবদ্ধভাবে) আমারই দাসত্ব কর। ’ -সূরা তওবা: ৯২
এই ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও জোর তাগিদ দিয়েছেন-
হজরত হারিছ আল আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, স্বয়ং রব আমাকে ওইগুলোর নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়গুলো হচ্ছে- সংঘবদ্ধ, আমিরের নির্দেশ শ্রবণ, নির্দেশ পালন, হিজরত এবং আল্লাহর পথে জিহাদ। যে ব্যক্তি সংঘবদ্ধতা ত্যাগ করে এক বিঘৎ পরিমাণ দূরে সরে গেছে সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলেছে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সালাত কায়েম এবং সাওম পালন করা সত্ত্বেও? এর উত্তরে রাসূল (সা.) বলেন, নামাজ কায়েম এবং রোজা পালন এবং মুসলমান বলে দাবি করা সত্ত্বেও। ’ –সুনানে তিরমিজি
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম অংশে বসবাস করে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে। ’ –তিরমিজি
আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব। কিভাবে ৩১৩ জন সাহাবী ১০০০ কাফের, মুশরিক বাহিনিকে বদর ময়দানে পরাজিত করেছিল। বদর থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি ঐক্যের, ভ্রাতৃত্বের। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী মুসলিম শাসন আমলে দেশ রক্ষা, নতুন দেশ বিজয়ে এবং ইসলাম প্রচারে ঐক্যবদ্ধ মুসলমানদের ভূমিকা আমরা দেখতে পাই।
বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা আগ্রাসন, ইহুদী, নাস্তিকদের মুসলমানের প্রতি একের পর এক আক্রমন, অত্যাচার, দখল ইত্যাদি ধ্বংসযজ্ঞে মুসলমানদের জর্জরিত করছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু দূর্ভাগ্য! পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ,শক্তি, লোকবল থাকার পরেও মুসলমানরা নিজেদেরকে তাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারছেনা। এর কারন, মুসলমানরা আজ আর ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনা। তারা ভুলে গেছে মহান সেই বাণী যে, মুসলমান হচ্ছে একটি দেহ একটি প্রাণ যার এক অঙ্গ আঘাত প্রাপ্ত হলে পুরো দেহ আঘাত প্রাপ্ত হয়। মুসলমানরা আজ তাদের অতীত ইতিহাস ভুলে গেছে, তারা অত্যাচারীদের অত্যাচার সহ্য করে পরাধীন হয়ে বাচতে শিখে গেছে। মুসলমানরা আজ শুধু নিজেদের কে নিয়ে ভাবে, অপর মুসলমানের প্রতি যে দায়িত্ব কর্তব্য ইসলাম তাদের উপর ন্যাস্ত করেছে তা আজ তারা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছে। কিংবা মানলেও শুধু মাত্র মুখের বাণীতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, মুসলমানদের উপর পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতিরোধে তেমন কোনো উল্ল্যেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখিনি।
তবে, এবার ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রতি চলতে থাকা জুলুম,নির্যাতন অন্যায়ের হাওয়া হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতেও লেগেছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দুবাদি দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর একের পর এক অত্যাচার, নির্যাতন চলেই আসছে। বিজেপির নেতৃত্বে প্রথমে তিন তালাক নিষিদ্ধ, নাগরিকত্ব বিল, হিজাব নিষিদ্ধ,স্পিকারে আযান, হালাল মিট ইত্যাদি যে কোনো ইস্যুতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন এখন নিত্য দিনের ঘটনা। যদিও এতো কিছুর পরেও দুই একটা মুসলিম দেশ ব্যাতীত কেউই উল্ল্যেখ যোগ্য কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।
কিন্তু গত কিছুদিন আগে শুরু হওয়া ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক জ্ঞানবাপী মসজিদে হিন্দুদের শিব-লিঙ্গ থাকার অজুহাতে মুসলমানদের উপর নতুন অত্যাচার শুরু হয়েছে। যদিও মসজিদ কমিটির বলছে, যেটাকে হিন্দু পক্ষ শিব-লিঙ্গ বলে দাবি করছে সেটা আসলে একটা ঝরণা। বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। এরই মধ্যে বিষটি এখন ভারতের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে। টিভি বিতর্ক, খবরের অনুষ্ঠানে সব জায়গায় জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
এমনই একটি টিভি বিতর্কে মুসলিম পক্ষের এক বক্তার সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মুসলমানদের নয়নের মনি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বসেন বিজেপির রাষ্ট্রীয় মূখপাত্র নুপুর শর্মা, ইসলাম বিদ্ধেশী হিসেবে নুপুর শর্মার বেশ ক্ষ্যাতি রয়েছে। পরবর্তিতে তার মন্তব্যের সমর্থনে টুইট করেন বিজেপির দিল্লী শাখার মিডিয়া প্রধান নাবিন কুমার জিন্দাল।
এই ঘটনায় সমগ্র ভারত জুড়ে নিন্দার জড় উঠে, মুসলমানরা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে কুটুক্তির প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন এবং নুপুর শর্মাসহ দোষীদের বিচারের দাবী জানান। কিন্তু দোষীদের বিচার না করে উল্টা কানপুরে মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ হিন্দুবাদীদের সাথে মিলে মুসলমানদের উপর হামলা চালায় এবং অনেক মুসলমানকে গ্রেফতার করে।
ঘটনার একসপ্তাহ পার হয়েগেলেও ভারত সরকার এই বিষয়ে উল্ল্যেখ যোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেইনি। এরই মধ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নুপুর শর্মাসহ দোষীদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়।
বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চড়িয়ে পড়লে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নিয়ে কুটুক্তি করায় ক্ষোভে পেটে পড়ে আরব বিশ্ব। এই সময় ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার জড় উঠে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ উক্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। সুপার মার্কেট সমুহে ভারতীয় বয়কটের হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষ করে কাতার, কুয়েত এই ব্যপারে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাতার, সৌদি আরব, ইরান ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে উক্ত ঘটনার কারণ দর্শানোর আদেশ দেন।
এছাড়াও মুসলিম দেশসমুহের সংস্থা ওআইসি, আরব আমিরাত, তুর্কিয়ে, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম দেশ এই জঘন্য কর্মকান্ডের নিন্দা এবং তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
আন্তর্জাতিক মহল এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ চাপের মুখে ভারত সরকার মাথা নুয়াতে বাধ্য হয়। বিজেপি বিতর্কিত নেত্রী নুপুর শর্মাকে ৬ বছরের জন্য এবং নাবিন কুমার জিন্দালকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। তবে, ভারতীয় মুসলমানরা শুধু বহিষ্কার নয় তাদেকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবী জানিয়েছে।
ভারতের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধতার শক্তি। মুসলমানরা চাইলে বিশ্বের যে কোনো পরাশক্তিকে মাথা নুয়াতে বাধ্য করতে পারে। তবে আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এই দূর্দশার কারণ হচ্ছে ইসলাম থেকে দুরে সরে যাওয়া এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। মুসলমান আজ কাফের, মুশরিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপর মুসলমানের ক্ষতি করায় ব্যস্ত হয়ে উঠছে।
হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে ইসলামকে আকড়ে দরার পাশাপাশি মুসলমান তথা মুসলিম নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকপ্ল নেই।
যোবায়ের হোসাইন রাকিব
শিক্ষার্থী,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post