মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, চট্টগ্রামঃ চট্টগ্রামের প্রথম ওষুধ রপ্তানিকারক হিসাবে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে দেশের স্বনামখ্যাত এবং চট্টগ্রামের সবচেয়ে স্বনামধন্য কোম্পানি এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। চট্টগ্রামভিত্তিক এলবিয়ন গ্রুপের সহযোগী এ প্রতিষ্ঠানের রফতানির অপেক্ষায় রয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯০ ডলারের ওষুধ, যার প্রথম চালানের জাহাজীকরণ আগামী মাসেই। আফগানিস্তানের কাবুলের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ জাহাজীকরণ সম্পন্ন হবে।
জানা গেছে, গত ২৯ মে রফতানির ব্যাপারে নিশ্চয়তা মেলে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আমদানিকারক দেশ থেকে প্রথম চালানের অগ্রিম ২০ শতাংশ অর্থ দেশে পৌঁছে গত ৯ জুন। এভাবেই উৎপাদন ও রফতানিতে ভিত শক্ত করে বড় হয়ে উঠছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রথম ওষুধ রফতানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে যাওয়া এলবিয়ন।
চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি আদর্শ উৎপাদন চর্চা (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি) সনদ অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আফগানিস্তান ছাড়াও ইয়েমেন, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ভুটান এ চারটি দেশে ওষুধ রফতানির একেবারে দ্বারপ্রান্তে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ। এর মধ্যে ইয়েমেন ও কম্বোডিয়ায় রফতানির সব ধরনের প্রক্রিয়া একেবারেই শেষ পর্যায়ে। ইয়েমেনে ৫৩ হাজার ৬৫০ ডলারের ১০টি ওষুধ পণ্যের রফতানিসংক্রান্ত ইনভয়েস ইস্যু হয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পিছিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় এর অনুমোদন হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে সে দেশ থেকে। ইয়েমেনের এডেন সি-পোর্টের উদ্দেশে ওষুধের চালানটি আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে এলবিয়ন কর্তৃপক্ষ। অন্য দেশ কম্বোডিয়ায় রফতানির উদ্দেশে নির্বাচিত ১৪ ধরনের ওষুধের ব্যাপারে চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার ও ভুটানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় অনুমোদন পেতে এলবিয়নের পক্ষ থেকে শেষ ধাপের ডকুমেন্টস পাঠানো হবে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে।
জানা গেছে, এলবিয়নের উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে জেনেরিক নামের পাশাপাশি ব্র্যান্ডেড নামও থাকবে। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য সীতাকুণ্ডে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এলবিয়ন। প্রায় ৪৫০টি মানবস্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট ওষুধের আইটেমের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে। এছাড়া নতুন পণ্য হিসেবে রয়েছে ওয়ানটাইম ইনজেকশন সিরিঞ্জ, ড্রপ, ইনজেকটেবল আইটেম।
ওষুধ রফতানির প্রক্রিয়ায় আমদানিকারক দেশের ডাটা পর্যালোচনা করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের একটি ছকও তৈরি করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে পর্যায়ক্রমে আমদানিকারক দেশের তালিকায় রয়েছে শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন। পরের ধাপে রয়েছে আফ্রিকার দেশ সুদান, ঘানা, সোমালিয়া, ক্যামেরুন আর নাইজেরিয়া। এছাড়া মালয়েশিয়ার ওষুধের বাজারে চীনের দাপট কমানোর ব্যাপারে আগ্রহী কুয়ালালামপুরও। এ কারণে দেশটিকেও গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে দেখছে এলবিয়ন। এজন্য বাজারটিতে প্রবেশের তথ্য বিশ্লেষণ করছে এলবিয়নের রিসার্চ টিম। পশ্চিমা দেশগুলোয়ও ওষুধের বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে এলবিয়নের।
এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত বলেন, চট্টগ্রামভিত্তিক প্রথম ওষুধ রফতানিকারক হিসেবে যাত্রা শুরু করতে পারাটা আমাদের জন্য অনেক বড় আনন্দের। ওষুধ শিল্পে আজ যাদের জায়ান্ট বিবেচনা করা হয়, যেমন স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো. হেলথকেয়ার, অপসোনিন, এসকায়েফ, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, এসিআই ও অ্যারিস্টোফার্মার মতো কোম্পানিগুলোও ছোট থেকে পর্যায়ক্রমে বড় হয়েছে। রফতানির উদ্যোগ নিয়ে যখন এগোচ্ছিলাম, অনেকেই তখন তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েনি। কিন্তু সেটা সম্ভব করেছি আমরা। ধাপে ধাপে ওষুধ খাতে নিজেদের মেধা, শ্রম, অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়িয়ে রফতানির বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনব। আমার বাবার হাতে প্রতিষ্ঠিত এলবিয়ন দেশের বাজারেও জায়ান্ট হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।
এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজের কর্মকর্তারা বলছে, একাধিক দেশে রফতানির জন্য মনোনীত কিংবা স্বীকৃতি পাওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। উৎপাদন কার্যক্রমে অনুসরণ করা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞায়িত জিএমপি। যথাযথ মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় পাস করেই এবং বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বড় কিছু সনদ অর্জন করেই আমাদের ওষুধ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য এখন প্রস্তুত হয়েছে। স্পর্শকাতর পণ্য হওয়ায় আমদানিকারকে দেশের ছাড়পত্র পাওয়া যেমন দুরূহ, তেমনি সময়সাপেক্ষ।
এলবিয়নের শুরুর গল্প: ১৯৯১ সালে ১০০ জন কর্মী নিয়ে ছোট পরিসরে ১৫ ক্যাটাগরি ওষুধ উৎপাদন শুরু করে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ভাড়া করা ভবনে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এই শুরুটা হয়েছিল মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিনের হাতে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তখন ব্যবসা পরিচালনার আসনেও বসেন তিনি। দ্বিতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ নেজাম উদ্দিনের সন্তানরা ব্যবসায় যুক্ত হন মূলত ২০০৬ সাল থেকে। বড় ছেলে রাইসুল উদ্দিন সৈকত অস্ট্রেলিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে দ্রুত দেশে ফিরেই কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডে। সেই সঙ্গে নিত্যনতুন পরিকল্পনায় বদলাতে থাকে কোম্পানিটির ব্যবসায়িক ধরন। রফতানিতে নিজেদের জানান দেয়াও এ পরিবর্তনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বড় ধরন।
বর্তমানে রাইসুল উদ্দিন সৈকত এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নেজাম উদ্দিনের দ্বিতীয় ছেলে মুনতাহার উদ্দিন সাকিব মালয়েশিয়ায় চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পড়াশোনা শেষ করে কোম্পানিতে যোগ দেন ২০১২ সালে। বর্তমানে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ছোট মেয়ে তাসনুভা আফরিন নিজেই একজন ফার্মাসিস্ট। তিনি বর্তমানে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ওষুধ উৎপাদনে ব্যবসার পরিসর বাড়লে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ডে ৫০ হাজার বর্গফুটের জায়গায় শুরু হয় ওষুধ উৎপাদন কার্যক্রম। ওষুধ রফতানির পরিকল্পনা নেয়ার পর থেকে অবকাঠামো সুবিধা সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা গেলে বর্তমানে পরিধি আরো বাড়ানো হয়। ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর ওষুধ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে এলবিয়ন গ্রুপ। ১০০ জনের সেই কারখানায় এখন তিন হাজার জনের সরাসরি কর্মসংস্থান হতে যাচ্ছে এলবিয়ন স্পেশালাইজড ফার্মা লিমিটেড উৎপাদনের যাওয়ার পর। এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ থেকে আরো গড়ে তোলা হয়েছে এলবিয়ন অ্যানিমেল হেলথ লিমিটেড, এলবিয়ন কনজিউমার প্রডাক্টস লিমিটেড, এলবিয়ন ট্রেডিং করপোরেশন, এলবিয়ন স্পেশালাইজড ফার্মা লিমিডেট ও ফ্যাভারিটা লিমিডেট। নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি এসিআই অ্যানিমেল হেলথের প্রায় শতাধিক ওষুধের টোল ম্যানুফ্যাকচ্যারিং হচ্ছে এলবিয়ন থেকে।
ওষুধ রফতানিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ গতিশীল করতে কিছু সুপারিশও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এলবিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাহার উদ্দিন সাকিব এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা স্বীকার করতে হবে, সরকারি প্রণোদনা এ শিল্পকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। শতভাগ কাঁচামাল দেশে উৎপাদিত হলে ওষুধের মূল্য কমে আসবে। পাশাপাশি ওষুধ ও কাঁচামাল রফতানির পরিমাণও দ্রুত বাড়বে। কাঁচামাল তৈরির জন্য মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট এপিআই পার্ক প্রস্তুত হয়ে গেলে এটা বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক হবে।
বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির এ যোগ্যতা অর্জনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ওষুধ রফতানি ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। আর কঠিন জায়গাটি জয় করেই ওষুধ শিল্পে নীরবে-নিভৃতে এগিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের উদ্যোক্তারা। ওষুধের আন্তর্জাতিক মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ চট্টগ্রামের এলবিয়ন গ্রুপ।
Discussion about this post