দারিদ্র্যকে জয় করার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে আসেন অনেকে। ভাগ্য বদলের আশায় ঘাম বেচে টাকা রোজগারের আশায় এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়ে দেন প্রবাসে। এই প্রবাস জীবনের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায় তাদের স্বজনদের কাছে। প্রবাসে প্রতিটি শ্রমিকই তাদের এ দুঃখ-কষ্টের কথা পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে আড়াল করতে চায়। শ্রমে ভেজা অনেক গল্প আড়ালেই রয়ে যায়।
এক সময় আরব আমিরাত ছিল বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। কিন্তু এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দুবাইয়ে শ্রমিকরা কাজ করছে। সীমাবদ্ধতার মাত্রাটা এমন যে কেউ যদি মারা যায় তার মরদেহটাও দেশে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না অনেক সময়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবার পর হয়ে যায় সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসী। কেউ চেনে না তখন তাকে। বাধ্য হয়ে পরকালের জীবনটাও তাদের কাটিয়ে দিতে হয় প্রবাসেই। ‘কোনমতে মাটিচাপা দেওয়া’ সেসব দুর্ভাগা প্রবাসীদের কবরটাও থাকে নিদারুণ অবহেলায়। একটি পাথরে থাকে কেবলই তাদের নাম। অনেকের ভাগ্যে তাও জোটে না। দাফন হয় বেওয়ারিশ হিসেবে।
মারা যাওয়া এসব ‘বেওয়ারিশ’ প্রবাসীদের দুবাইয়ের আল কুসাইস সিমেট্রিতে (কবরস্থান) দাফন করা হয়।
এ কবরস্থানটি দুবাইয়ের মূলশহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। গাড়ি নিয়ে কবরস্থানটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি কবর। দুবাই প্রবাসী ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের কবর। তবে অধিকাংশ কবরই বাংলাদেশিদের। এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা মারা গেলে তাদের পরিবার অথবা দেশটির সরকার বা এনজিও মরদেহ বহন করে দেশে পৌঁছে দেয়। তবে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। প্রবাসী যদি গরীব হয়, তাহলে তার মরদেহের ঠাঁই হয় এই কবরস্থানে। সরকার কিংবা কোনো সংগঠনই মরদেহ বহনে রাজি হয় না।
কবরে চিহ্ন বলতে একটি পাথর। সেই পাথরে রং দিয়ে প্রবাসীর নাম লেখা, অনেকক্ষেত্রে ইউএই রেসিডেন্ট আইডিও লেখা থাকে। জিয়ারত করা দূরের কথা হাতেগোনা দু-একজন বাংলাদেশি ছাড়া কেউ দেখতেও যায় না সেই কবর। পরিবারকে সচ্ছল করার সংকল্প নিয়ে প্রবাসে আসা প্রবাসীর যে মরণকালে এমন দৈন্যদশা হবে কেইবা ভেবেছিল!
প্রতিদিনই দুবাইয়ের কোনো না কোনো এলাকায় মৃত বাংলাদেশিদের মরদেহ দুবাই’র বিভিন্ন কবরস্থানেই দাফন করা হচ্ছে। তবে যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধা দিনরাত পরিশ্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে তাদের মরদেহ নিয়েই অবহেলা হয় নিয়মিত।
সোনাপুর লেবার ক্যাম্পের প্রবাসীরা জানান, এখানে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রবাসীরা থাকে। এখানকার কেউ মারা গেলে পরিবারের বা সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ মরদেহই নিতে আসে না। এসব মরদেহ স্থানীয় মেডিকেলে ১০-১২ দিন ফ্রিজে থাকে। এরপর এগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়। অনেকটা অবহেলায় তাদের এই কবরস্থানে দাফন করা হয়। অনেকসময় তারা কবরে চিহ্ন দেয় না। মৃত্যুবরণকারীর সহকর্মীরা মার্কার দিয়ে নিজ দায়িত্বে নাম লিখে দিয়ে আসে।
সব দেশের সরকার নিজ দায়িত্বে প্রবাসীদের মরদেহ নিয়ে যায়। একমাত্র বাংলাদেশ সরকার খবর নেয় না। দুবাই’র বিধান অনুযায়ী যে কোনো প্রবাসী মারা গেলে তার ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য সময় লাগে ১০-১২ দিন। এই কয়দিন মরদেহ ফেলে রাখা হয় স্থানীয় হাসপাতালের ফ্রিজে। তারা ইচ্ছেমতো সময়ে সেগুলোর ময়নাতদন্ত করে। ময়নাতদন্তের পর কেউ মরদেহ না নিলে আল কুসাইস সিমেট্রিতে দাফন করা হয়। এর জন্যও টাকা লাগে।
আমরা যারা প্রবাসে থাকি, আমাদের পরিবারের লোকজন আমাদের দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আমরা মারা গেলে যাতে অন্তত টাকার অভাবে আমাদের মরদেহ এখানে আটকে না থাকে, যাতে আমার পরিবার অন্তত লাশটুকু দেখতে পারে, সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে বিশেষ অনুরোধ করছি।
ঢাকা পোস্ট
Discussion about this post