মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে শান্তির বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি পরিবার, সমাজ ও গোটা পৃথিবীর সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল হয়েছেন। বিশেষ করে নারীদের তিনি যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আল্লাহ পাকের কাছে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ভিন্ন নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন- ‘অতপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না। তা সে পুরুষ হোক কিংবা নারী। তোমরা পরস্পর এক।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯৫)
এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, আমলের দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী। নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। সর্বত্রই নারীরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে। এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না, যেদিন নারী নির্যাতনের কোনো সংবাদ পত্রিকার পাতায় স্থান পায় না।
অথচ ইসলামে একজন নারীকে যে এত উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, তা যেন আজ আমরা ভুলতে বসেছি। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তাতে মনে হয় আমরা আবার সেই আইয়্যামে জাহেলিয়াত তথা অজ্ঞতার যুগে ফিরে যাচ্ছি। দড়ি বেঁধে প্রকাশ্যে নারীর ওপর অত্যচারের দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়।
একটু চিন্তা করুন-
ইসলামের আগমনের আগে নারীর মর্যাদা কেমন ছিল। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতো। রাতের বেলায় নারী মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব করতো। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাস্কর মনে করতো। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে জ্ঞান করা হতো। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না।
কিন্তু যখনিই দুনিয়ায় মানবতার মুক্তির দূত, নবীকূল শিরোমনি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটে। তখন থেকেই নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে।
নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই সর্ব প্রথম নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বস্তুতঃ কুরআনুল করিমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
একইভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের স্বামীর সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন।
একবার নামাজ পড়াবার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এজন্য নামাজ পড়ানো তিনি তাড়াতাড়ি শেষ করেছিলেন। তাপরপর বললেন- ‘একটি বাচ্চা কাঁদছিল, আমার মনে হলো, ওর মায়ের মনে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম, যাতে বাচ্চার মা তার বাচ্চার খবর নিতে পারে।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সফরে যেতেন, তখন নারীরাও সঙ্গে থাকতেন, যার ফলে সবাইকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন।
একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলিকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করলো, তখন তিনি বললেন-
‘আরে তোমরা করছো কি! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! অর্থাৎ, করছো কি! নারীরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবে উট দাবড়াতে থাকো, তাহলে তো ঐ কাঁচগুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।’ (বুখারি)
একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক নারীও পড়ে গিয়েছিলেন।
এক সাহাবী পেছন থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পা তখনো রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ওই সাহাবিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ওই দিকে, নারীদের দিকে যাও।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি সব মুসলমানদের সমবেত করে যেসব ওসিয়্যত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি উপদেশ ছিল এ রকম-
‘আমি তোমাদের আমার এই শেষ ওসিয়্যত (উপদেশ) করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাও প্রায়ই বলতেন- ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শিখায়, এবং ভালোভাবে তরবিয়ত করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।’ (তিরমিজি)
সাধারণ আরবদের মধ্যে এটি রেওয়াজ ছিল যে, নারীরা যদি কোনো ভুল-ত্রুটি করতো, তবে তাদেরকে মারধর করা হতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ বিষয় জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন-
‘নারীরা আল্লাহ তাআলার দাসী, তোমাদের নয়। তাদেরকে কখনোই মারধর করবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’
এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমত প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহে প্রথমবারের মত নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ)
হজরত মাবিয়া আল কুশায়বি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম-
‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন,‘আল্লাহ তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, আল্লাহ তোমাকে যা পরতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পরতে দাও আর তাকে কখনও থাপ্পর মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না।’ (আবু দাউদ)
ইসলাম এমনই এক পবিত্র জীবন ব্যবস্থা; যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার বিষয়টি ঘোষণা করে।
তাই একথা স্বীকার করতে হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর যে মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন তা বিরল।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নারীর এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও যথাযথ ব্যবহার দেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট.
Discussion about this post