কক্সবাজারের টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস। দীর্ঘ ২২ মাস এই থানার দায়িত্ব পালনের পর গতকাল বুধবার প্রত্যাহার হয়েছেন। এই ২২ মাসে তিনি ১৪৪টি ক্রসফায়ার দিয়েছেন। তাতে মারা গেছে ২০৪ জন। এর অর্ধেক ক্রসফায়ারই হয়েছে মেরিন ড্রাইভে। যে ২০৪ জনকে তার নির্দেশে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে একই বাড়ির চার জন, এমনকি দুই ভাইও আছেন। চাহিদামতো টাকা না পেলে নির্বিঘ্নে দিতেন ক্রসফায়ার। ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচার করে দায়মুক্তিও পেয়ে যেতেন। তবে টেকনাফের মানুষ বলছেন, তিনি মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার জন্য এসব ক্রসফায়ার দিতেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা।
মামলায় বলা হয়েছে, রাশেদকে গাড়ি থেকে নামতে বলে এসআই লিয়াকত বলেন, ‘তোকে খেলা দেখাচ্ছি। তোর মতো কত মেজর দেখেছি। এটা বলেই সে ওসি প্রদীপকে ফোন দেয়। একপর্যায়ে বলে ঠিক আছে স্যার, শালাকে খতম করে দিচ্ছি। এই কথা বলে গুলি করে। রাশেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওঠার চেষ্টা করলেও অন্যরা তাকে চেপে ধরে। পরে ঘটনাস্থলে এসে ওসি প্রদীপ বুকে ও মাথায় লাথি মারে এবং পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে।’
লিয়াকত আলী নামে প্রত্যক্ষদর্শী এক ইজিবাইক চালকও বলেন, ‘দুই জন মহিলাযাত্রী নিয়ে আমি সে সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছি। পুলিশ ঐ প্রাইভেট কার থেকে মাত্র ১০-১৫ গজ দূরেই আমার গাড়িটি থামায়। দেখছিলাম প্রাইভেট কারটি স্লো গতিতে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় শামরাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থামানোর পর অস্ত্র তাক করে গাড়ির অভ্যন্তরে থাকা যাত্রীদের বের হতে বললেন। পরে দেখি এক জন লোক গাড়ি থেকে নেমে হাত তুলে দাঁড়ান। এমন সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। পরে গাড়ির ভেতরে থাকা আরো এক জনের পায়ে গুলি করে। ভয়ে আমার যাত্রীরা পালিয়ে যায়। আমিও পালিয়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদের ছাদে গিয়ে অবস্থান নেই। সেখান থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ঘটনাস্থল। দেখি, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে পা দিয়ে আঘাত করছে পুলিশ। পরে পুলিশের একটি গাড়িতে তুলে কক্সবাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল আমিন নামে মসজিদের এক ইমাম বলেন, ‘খুবই গরম অনুভূত হচ্ছিল বলে এশার নামাজ শেষে মসজিদের ছাদে বসেছিলাম। হঠাত্ দেখি পুলিশের একটি দল কক্সবাজারগামী একটি প্রাইভেট গাড়ির গতিরোধ করে। কিছু বোঝার আগেই দেখি গাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়া যুবককে গুলি করল পুলিশ।’
হামিদ উল্লাহ নামে অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাস্তার কিনার দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন দেখি পুলিশ একটি কারকে থামায়। কারটি দাঁড় করিয়ে আরোহীদের নামতে বলে পুলিশ। আর্মির গেঞ্জি পরা এক যুবক হাত ওপরে তুলে নেমে কিছু বলার আগেই গালি দিতে দিতে গুলি করে পুলিশ। গুলি খেয়ে ঢলে পড়ার পর যখন ব্যথায় কাতরাচ্ছিল যুবকটি তখন পা দিয়ে গলা চেপে ধরেছে পুলিশের সদস্যরা। এর ১৫-২০ মিনিট পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আসে। ওসিও তাকে পা দিয়ে নেড়ে দেখে, পুলিশের চার সদস্য গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে ধরে রাস্তার পার্শ্বে নিয়ে যায়। মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী টেকনাফে ৫৪ জন ইয়াবা গডফাদার। তাদের স্বার্থ রক্ষাই ছিল মূলত ওসি প্রদীপের কাজ।
টেকনাফের সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ওসি প্রদীপ যোগ দেওয়ার পর থানায় সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ করে। কেউ তার বিরুদ্ধে নিউজ করলে তার পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করত।
পুলিশের কয়েক জন কর্মকর্তা বলেন, এসপি ও ডিআইজি অবহিত হওয়া ছাড়া এই ধরনের অপকর্ম সম্ভব নয়। বিশেষ করে কক্সবাজারের এসপি শুধু উেকাচ নয়, এসব ক্রসফায়ারের একটা স্বীকৃতিও দিতেন। মেজর (অব.) রাশেদকে হত্যার পরদিন এসপি সাংবাদিকদের ব্রিফ করে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করেন। অনেকেই বলছেন, এসপির মদতেই ওসি প্রদীপ দানব হয়ে উঠেছে। তাকেও দ্রুত প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথাও বলেছেন অনেকে।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘তাদের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কতিপয় ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার বাহিনী নেবে না। পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, যারা অপকর্ম করবেন তাদের কোনো ক্ষমা নেই। কোনো ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার বাহিনী নেবে না।
ইত্তেফাক
Discussion about this post