মাইনুল আহসান নোবেলকে নিয়ে আমার মধ্যে খানিকটা সংশয় বরাবরই ছিল। জি বাংলার সারেগামাপা অনুষ্ঠানে তিনি যেসব গান গেয়েছেন, বা তার গাওয়া যে গানগুলো খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই রক ঘরানার। মাইলসের ‘ফিরিয়ে দাও’ গানটা তার কণ্ঠে শুনে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি, তবুও সংশয়টা কাটেনি, মনে হয়েছে, অন্য ঘরানার গানগুলো তার কণ্ঠে কেমন লাগবে, কতটা মানাবে? এবং এটাও সত্যি যে, নোবেলের কণ্ঠে একটু ভিন্ন ধারার গানগুলো শুনে খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ‘বেঁচে থাকার গান’, কিংবা ‘সেই তুমি’র মতো পারফরম্যান্সগুলোতে নোবেল নিজের পুরোটা ঢেলে দিতে পারেননি বলেই মনে হয়েছে। আর তাই নোবেল কি জি বাংলার টিআরপি ফ্যাক্টর কিনা, সেই প্রশ্নটাও মনের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল বেশ কয়েকবার।
গতকাল সারেগামাপা- তে নোবেল সুফী ঘরানার একটা কাওয়ালি গেয়েছেন। এবং মুগ্ধতা নিয়েই বলছি, তিনি চমৎকার গেয়েছেন! অথচ কাওয়ালি মোটেও তার টাইপের গান নয়, নোবেলের স্ট্রং জোন তো একদমই নয়। নিজেকে প্রমাণের দারুণ একটা সুযোগ নোবেলের সামনে, আবার ভুল করার সুযোগও ছিল পুরোপুরি। সেই দোদুল্যমান জায়গাটায় দাঁড়িয়ে নোবেল সম্ভবত তার জীবনের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সটাই উপহার দিলেন।
মঞ্চে কি চমৎকার তার উপস্থাপন! হিন্দি ভাষার এই গানটাকে ভীষণ আপন করে নিলেন নোবেল, গাইলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়, তার চেহারার দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছিল, গাইবার পুরোটা সময় তিনি দারুণ উপভোগ করছেন, নোবেলের এই দারুণ পারফরম্যান্স উপভোগ করেছি আমরাও। দুয়েকটা জায়গায় হিন্দি উচ্চারণটা একটু অন্যরকম হয়ে কানে বেজেছে, শুরুতে ফ্লো-টা ধরতে সময় নিয়েছেন, তবে গানের ভেতরে ঢুকে যাবার পরে নোবেল হয়ে গিয়েছেন অন্য মানুষ। তারপরের গল্পটা কেবলই মুগ্ধতার!
নোবেলের একেকটা পারফরম্যান্স মানেই পরের কয়েকটা দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া পড়ে যাওয়া। ‘খাজা মেরে খাজা’ শিরোনামের এই গানটার বেলাতেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনেকের কাছে এটাই এখন পর্যন্ত নোবেলের সেরা পারফরম্যান্স! জোধা-আকবর সিনেমায় এ আর রহমানের গাওয়া এই গানটাকে সারেগামাপা’র মঞ্চে চমৎকারভাবে পোট্রে করেছেন নোবেল, ছড়িয়েছেন একরাশ মুগ্ধতা, সেই মুগ্ধতায় ভেসেছে দর্শক, ভেসেছেন বিচারকেরাও।
নোবেলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেও অবাক হয়েছিলাম। গান শুরুর আগে ভেবেছিলাম, এই রাউন্ডে বুঝি তিনি গুবলেট করে দেবেন সব। অথচ প্রত্যাশার চেয়ে সেবার অনেক ভালো গেয়েছিলেন তিনি। এমন নয় যে দুর্দান্ত কোন পারফরম্যান্স ছিল সেটা, কিংবা নোবেল ফাটিয়ে দিয়েছিলেন সেবার৷ কিন্ত ‘আমারও পরাণ যাহা চায়’ গানটাকে নষ্ট হতে দেননি নোবেল, পুরোটা গানই তিনি আবেগ দিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এবং মোটামুটি সফলও হয়েছিলেন। গান শুনে বোঝাই যায়নি যে, জীবনে প্রথমবারের মতো মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন নোবেল!
এবার সুফী ঘরানার কাওয়ালি গেয়েও নোবেল প্রমাণ করলেন, তাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে হাইপটা উঠেছে, সেটা একেবারেই অমূলক নয়। আর নিজেকে শুধু এক ছকের গানে বেঁধে রাখার ইচ্ছেটাও তার নেই। তিনি নিজেকে ভাঙতে চান, নিজের সামর্থ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান। সারেগামাপা’র মঞ্চে সেটাই তিনি করে চলেছেন।
ঐশ্বরিক প্রতিভা তো তার আছেই, সেইসঙ্গে আছে নতুন কিছু করার অদম্য একটা বাসনা। নোবেল জানেন, নতুন কিছু করতে যাওয়ায় ঝুঁকি আছে, কিন্ত সেটাকে জয় করার মধ্যে অন্যরকম আনন্দও আছে। নোবেল সেই আনন্দের খোঁজেই ছুটছেন হয়তো। রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা এ আর রহমানের কাওয়ালি সেসবেরই উদাহরণ।
না, নোবেল শুধু টিআরপি প্রোডাক্ট নন, তার মধ্যে ম্যাজিক্যাল একটা ব্যাপার আছে অবশ্যই। প্রায় প্রতি পর্বেই বিচারকেরা তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন, সঞ্চালক যিশু সেনগুপ্ত নোবেলের পারফরম্যান্সে নিজের মুগ্ধতার কথা জানাচ্ছেন বারবার, এগুলো মোটেও ফ্লুক নয়। নোবেল নিজের দমে এতদূর এসেছেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, নিজের প্রতিভাতেই টিকে আছেন সারেগামাপা’র মঞ্চে, কারো ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে নয়। নোবেলের জন্যে শুভকামনা…
সেলিব্রেটিবিডি/এইচআর
Discussion about this post