বিমান ছাড়ার পূর্ব মূহুর্তের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে শেষ করেছিলাম আমার লেখা ”ফেরা” উপন্যাসটি। প্রবাসীদের জীবন-চিত্র আংশিক তুলে আনার ব্যর্থ চেষ্টা ছিল তাতে। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের বই মেলায়। যাদের পড়ার সুযোগ হয়েছে তারা নিশ্চয়ই কয়েকজন প্রবাসীর ঘটনা প্রবাহ নিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর যতসামান্য অনুভূতির কথা জেনেছেন। আমি অনেক সময় বলে আসি, একেকজন প্রবাসী একেকটি উপন্যাস। এরা একেকজন জীবন্ত কিংবদন্তি। বিষয় তা নয়, আমার কথা অন্য বিষয়ে। গত ক’দিন ধরে বিমান অবতরণের ঘটনা বর্ণনা নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি ভিডিও ভার্চুয়াল জগতে ঘুরছে। সেই ভিডিও বক্তব্য নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। যেখানে তিনি বিমানে অবস্থানরত কিছু প্রবাসীকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন। অবশ্য ঢাকায় বসেই তিনি ওই বক্তব্য রাখলেন। উনার কথায় উপস্থিত সবাই বেশ হাসি-ঠাট্টাও করলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগেনি। বস্তুত পক্ষে দেশে একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ আছে, যারা প্রবাসীদের এভাবেই মূল্যায়ন করেন। তাদের কাছে প্রবাসী মানেই খেটে খাওয়া কামলা। কয়েকবছর পরপর দেশে আসবে আবার চলে যাবে। তাদের দেশপ্রেম বা দেশে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছুই নেই অথবা কিছু থাকতে পারবে না। তারা শুধু রেমিটেন্স পাঠাবে, তাদের কাজই রেমিটেন্স পাঠানো ! এটা বড় কিছু নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে তিনি যা বলেছেন তা আংশিক সত্য ছিল। কিছুটা রস মিশ্রিত হওয়াতে কথাগুলো রসিকতায় পরিণত হয়ে গেছে। যা কিনা অন্যের হাসির খোরাক হলো, হাসির পাত্র হলেন প্রবাসীরা!
এই যেমন- কোট স্যুট, স্যুট-ব্লেজার পরা, পেপার ফিল আপ করে দেয়া, এই দুটো ব্যাপার হরহামেশা ঘটে। বহু বছর পর দেশে যাবার বাড়তি আনন্দ অথবা হঠাৎ করে প্রিয়জনদের মুখোমুখি হবার আগ্রহে অনেকে পোশাকে পরিবর্তন আনেন। তবে কেউ কেউ যে বাড়তি স্মার্টনেস প্রদর্শন করেন না তাও কিন্তু নয়! অনেকে প্রবাসেও কোট-স্যুট পরে নিজেকে জাহির করেন আবার দেখা যায় পরে তিনি অন্তসারশূন্য ! পেপার ফিল আপ করে দেয়ার এমন একটি ঘটনা আমার সঙ্গেও ঘটে ছিল। পাশে বসা ভদ্রলোক স্যুট পরা। পুরো সময় জুড়ে অনেক কথাই হয় আমাদের। বিমানবালার দেয়া পেপারটি তিনি পূরণ করতে পারছিলেন না। আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি হাসি মুখে সেটি পূরণ করে দিলাম। ওটা দেখে আরো কয়েকজন হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। একটি বিমানে তিন-চার’শ যাত্রী থাকেন। তাদের প্রত্যেকে যে উচ্চ শিক্ষিত নয় এটি সকলেই বুঝেন, জানেন। এদের অনেকে নিম্ন আয়ের শ্রমিক, এটিও সত্য। এমন ঘটনা স্যার, আপনার সঙ্গেও ঘটতে পারে। তবে কষ্ট পেলাম অন্য ব্যাপারগুলোতে এই যেমন আপনি বললেন – ‘ আমি একবার দুবাই থেকে আসছি ঢাকায়। বহু মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক সেই প্লেনে গাট্টি নিয়ে উঠেছে। যারা আসছে তাদের মধ্যে একটা অস্থির উম্মাদনা, আর পারে না ! অস্থির, পাগল! কোথায় দেশ, কোথায় মা, কোথায় বাবা, কোথায় ঘর সংসার, কোথায় সেই সহপাঠিনি! প্লেনের এই দরজা দিয়ে ঢুকছে, মনে হয় ওই দরজা দিয়ে নামবে। সত্যি সত্যি কি মর্মান্তিক গল্প !’ এই কথাগুলো বহু সংখ্যক প্রবাসীর মনে কষ্ট দিয়েছে স্যার! আপনি হয়ত তাদের অনুভূতিতে বেশ আঘাতও দিয়ে দিলেন। কথা হচ্ছে, এসব আপনার কাছে মর্মান্তিক লেগেছে! কিন্তু একজন প্রবাসীর কাছে এই মুহূর্তটাই জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বলেই আমার কাছে মনে হয়। কারণ তারা একটি বন্দি জীবন থেকে মুক্তির খোঁজে উন্মুক্ত আকাশে উড়ে দেশ-মাতৃকার টানে ফেরার স্বপ্নে বিভোর তখন। তাদের কাছে তখন মনে হয়, এই তো আর কিছুক্ষণ পরেই দেখা মিলবে মা-বাবার। সান্নিধ্য পাবে প্রিয়জনের। প্রিয় মুখগুলো এতদিনে কেমন হয়েছে, কতটুকু পরিবর্তন এসেছে প্রিয় সন্তানের। এসব চিন্তাই তো তাদের তখন মাথায় ঘুরপাক খায় স্যার! আপনি নিশ্চয়ই বুঝে উঠতে পারেননি। আপনার অন্য বক্তব্যটিও আমার ভাল লাগেনি। আপনি বললেন- ‘আসে না কেন, বাংলাদেশ কোথায় ? খালি তাকায়। এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়। আমার মনে হয় যে, পাইলটের মাথার উপর দিয়েও তাকায়। কে একজন বললো ” আইসা গেছে”। সমস্ত প্লেন দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মেরে, পিটিয়ে, বসানো হলো।’ আপনি শুধু তাদের উম্মাদনা দেখেছেন তাদের মধ্যে দেশের জন্যে মায়া, দেশপ্রেম, নাড়ির টানটুকু দেখলেন না ! আপনি মহান মানুষ। আপনার অনুভূতির শক্তি অনেক প্রখর অথচ আপনি প্রবাসীদের দেশের প্রতি যে টান সেটুকুই বুঝতে পারলেন না স্যার!
আপনাকে জানাতে বলছি স্যার, একজন প্রবাসী ইচ্ছে করলেই দেশে যেতে পারে না। নির্ধারিত সময় পার করতে হয় তাদের। চুক্তির সময় শেষ করতে হয়। কেউ কেউ চুক্তির সময় শেষ করে ভিসা মেয়াদ পুনরায় নবায়ন করেন। টিকেট কেনার টাকা জোগাড় করতে সময় লেগে যায়। টিকেটের টাকা হলে আবার প্রিয়জনদের জন্যে উপহার কেনার টাকার পেছনে ছুটতে হয় তাদের। এভাবেই তো সময় কাটে। যখন টাকার বন্দোবস্ত হয়, টিকেট কেনা হয়, উপহার কেনা হয় তখন থেকে তাদের চোখের ঘুমও চলে যায়। শুরু হয় অপেক্ষার সময়। বিমানে বসার আগ পর্যন্ত একটুও নিদ্রায় যেতে পারে না। ছটপট করে। কখন ফ্লাইটের সময় হবে, কখন তারা দেশের মাটিতে পা রাখবে, কখন প্রিয়জনের চোখে চোখ রাখবে। এতটুকু বাড়তি আগ্রহ, উম্মাদনা তো তাদের থাকবেই স্যার। কারণ তারা যে বছরের পর বছর প্রিয় মানুষগুলো থেকে দূরে আছে। অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হতে সংগ্রাম করেছে। এখন তাদের বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফেরার পালা। মুক্তিযোদ্ধারা যখন যুদ্ধ জয় করে বাড়ি ফিরছেন তখন তাদের অনুভূতির কথা নিশ্চয়ই আপনার লেখনিতে বেশ করে তুলে ধরেছেন নিশ্চয়ই। প্রবাসীরাও কিন্তু যোদ্ধা, তাদের যুদ্ধ জয় করে ফেরার অনুভূতিটুকু ধরতে পারলেন না কেন, স্যার ? এই প্রশ্নটি কি করা যাবে! তাদের অনুভূতিগুলো, তাদের আগ্রহগুলো আপনাদের মত গুণী মানুষরা ধরতে পারার কথা, বুঝতে পারার কথা তাদের ব্যয় করা সময়ের হিসাব!
শেষে আমার প্রিয় প্রবাসী ভাই-বন্ধুর জন্যে বলছি, আপনারা জীবনের একটি বড় অংশ প্রবাসে কাটিয়ে দিচ্ছেন। মাত্র অল্প কয়েক ঘন্টার যাত্রাপথ। অথচ বিমানে বার বার বলতে হয়, আপনারা শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। বিমান পুরোপুরি থেমে যাবার আগে সিট থেকে উঠার জন্যে বারণও করা হয়। কিন্তু আমরা এতটুকু আর ধৈর্য্য রাখতে পারি না। মাত্র ২-৩ মিনিট পর বিমান থেমে যাবে, ঠিক এর আগ মূহুর্তে অনেকে মাথার উপর থেকে ব্যাগ নামাতে ব্যস্ত হয়ে যাই। এই ২-৩ মিনিটের অতি আবেগ আর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নানা মানুষের কাছে প্রবাসীদের হাসির পাত্রে পরিণত করে। মনে রাখবেন, নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সচেতন হলে, সামগ্রিক সচেতনতা বাড়ালে কেউ আর প্রবাসীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার সুযোগ পাবে না
কামরুল হাসান জনি, লেখক : সাংবাদিক; আরব আমিরাত প্রতিনিধি, সমকাল।
Discussion about this post