মামুনুর রশিদ তানিম:
ঈদকে ঘিরে নির্মাতারা নানা ধরণের নাটক, টেলিফিল্ম তৈরী করেন। এর মধ্যে বেশ কিছু নাটক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। গল্প ও নির্মাণ শৈলীর কারণে দর্শকের মনে স্থান করে নেয় এসব শিল্পকর্ম। এবার ঈদে বিভিন্ন চ্যালনল, ইউটিউবে প্রচারিত নাটকগুলোরে মধ্য থেকে আলোচিত কয়েকটি তুলে ধরা হলো-
আয়েশা
” আমার স্বামীর কবর কই, তা আমি জানি না। তাই আমার জন্য এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলই আমার স্বামীর কবর। আমি যেইখানেই জিয়ারত করি, আল্লাহ্ তা কবুল করবেন “।
আনিসুল হকের ” আয়েশামঙ্গল ” থেকে রচিত এই নাটক দিয়ে ৯ বছর পর টিভি নাটকে ফিরলেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। আয়েশার স্বামী বিমান বাহিনীর করপোরাল জয়নাল আবেদীন। বিমান বাহিনীর চীফকে বাঁচায় সে কিন্তু জড়িত সন্দেহে উল্টো তাকেই ধরে নিয়ে আটক করা হয়। সে রাতে খেতে বসে আয়েশাকে বলেছিল, পরিস্থিতি খারাপ। দলে জাসদ ঢুকে পড়েছে। তবে তাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। সকালের আগেই ফিরবে কথা দিয়েছিল। কিন্তু ফেরে নি। আর এরপরের গল্প আয়েশার বেদনাকাব্য।
” আয়েশামঙ্গল ” থেকে খুবই দারুণ একখানা চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। দারুণ, মর্মস্পর্শী সব সংলাপে ঘেরা। ফারুকি পুরো কাজটায় খুবই ইন্টেন্স, ট্র্যাজিক, খানিকটা বিদ্রুপাত্মক টোনের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। খুব বেশি ওভার ড্রামাটাইজেশনে গল্পবলিয়ে, চিত্রনাট্য ভোগে নি। সিনেমাটোগ্রাফিতে স্ট্যাটিক পজিশন বেশ ব্যবহার করা হয়েছে। তিশার অন্যতম সেরা অভিনয়, এই ঈদে তার ব্যাক্তিগত সেরা অভিনয় আয়েশা চরিত্রেই হয়েছে বলে মনে হয়েছে। ঈদের সেরা কাজ ফারুকিই উপহার দিলো।
সোনালি ডানার চিল
” হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে, তুমি আর কেদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে “। গতঈদের সেরা, ফেরার পথ নেই এর পর আশফাক নিপুণ এলেন এবার সোশ্যাল কমেন্টারি বেইজড গল্প নিয়ে। ভর্তিযুদ্ধের পেছনের এক মানবিক গল্প নিয়ে। প্রশ্নফাঁসের মতো ঘৃণিত কাজের কারণে অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়া প্রতিভার হৃদয়স্পর্শী গল্প নিয়ে। সরল আঙ্গিকে লেখা খুবই চমৎকার এই নাটকের চিত্রনাট্য। ছোট ছোট হাসি-আনন্দের ঘটনাগুলো অনেক বেশি রিলেটেবল। তার কারণ আশফাক নিপুণের মানবিক গল্পবলিয়ে এবং পোক্ত পরিচালনা। সেইসাথে প্রত্যেকের চমৎকার অভিনয়।
আমার নাম মানুষ
জন্মের পরই নির্দিষ্ট নাম আর গোত্র দ্বারা পরিচিতির ধারায় আমরা ভুলে গেছি আমাদের আসল পরিচয়। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো, আমার নাম মানুষ? নজির স্থাপন করা কিছুদিন আগের ছাত্র আন্দোলনকে ট্রিবিউট দিয়ে তৈরি এই নাটক। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়িম, দুর্নীতি, অনাচারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ উঠে এসেছে নাটকের গল্প এবং গল্পবলিয়েতে। চিত্রনাট্য, চরিত্রগুলোতে অন্যায়, প্রতিবাদ আর নতুন সম্ভাবনা তুলে এনেছেন শাফায়েত মনসুর রানা। বরাবরই যিনি ভিন্নতা আনেন তার কাজে। প্রতিবাদের ভাষাটা এখানে স্পষ্ট, আবেদন’টা গভীর। তারিক আনাম খান এর মনোলগ গুজবাম্প দেয়। এর শেষটা এক নতুন উদ্যোম জাগায়। আবারো দারুণ একটি কাজ উপহার দিয়েছেন শাফায়েত মনসুর রানা।
কলি ২.০
” সেলিম তুই জানোস না, বাপের আগে পোলার বা* গজাইলে কি হয় ” ? লোকাল ড্রাগমাফিয়া, তার গুণধর পুত্র আর সমাজের চোখে বাজারি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এক মেয়ে কলি। সেলিম আর কলির প্রেমের গল্প। তবে আর দশটা প্রেমের গল্প নয়। ড্রাগে আসক্ত কলির চরিত্রটি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড এ ড্রাগ তরুণ সমাজে কিভাবে ছড়াচ্ছে তা বেশ ভালোভাবেই দেখানো হয়েছে।
একদম র স্টাইলে সাজানো হয়েছে এই নাটক। সংলাপে রাখঢাক নেই। এতটা বোল্ড সংলাপ আমাদের নাটকে বিরল। চিত্রনাট্যও সাজানো হয়েছে খুব র স্টাইলের ক্রাইম, ড্রামার আদলে। আবরার আতহার একইসাথে খুউউব স্টাইলিশ এবং সাবস্ট্যান্সফুল কাজ উপহার দিয়েছেন। চমৎকার কালার গ্রেডিং, লো-কি লাইটিং, ব্যাকগ্রাউন্ড এ রক আর মেটাল মিউজিকের ব্যবহার এই নাটককে একদম সিনেম্যাটিক করে তুলেছে। শেষ দিকে একটু তাড়াহুড়ো করেছে আর সম্পাদনায় আরেকটু জোর দেওয়া দরকার ছিল। এমন রিয়েলিস্টিক ক্রাইম, ড্রামা নাটকে মেলে না সচরাচর।
লিংক- বায়োস্কোপ লাভ।
দ্যা অরিজিনাল আর্টিস্ট
কিছুদিন আগেই জাতীয় পুরষ্কারে এক বিভাগের পুরষ্কার নিয়ে বেশ জলঘোলা হয়েছিল। এমন একজনকে পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল যিনি নাকি ওই কাজটাই করেন নি ! ঠিক এমনই গল্প উঠে এসেছে এই নাটকে। ভুল হওয়ার পর ও সংশ্লিষ্ট লোকজন তাদের ভুল স্বীকার করতে রাজি নয় নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সম্মানেত কথা ভেবে। অন্য দিকে সে আর্টিস্ট এ পুরষ্কার নিবে না কোন অবস্থাতেই।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে ভুলই সঠিক বানানোর মন্ত্রে বিদ্রুপ ঢেলে দেওয়া হয়েছে নাটকের টোনে। মাহমুদুল ইসলাম শার্প স্টোরিটেলিং আর গ্রিটি ডিরেকশানের দারুণ নাটক। কামরুজ্জামান কামু, মুকিত দুজনেই চমকপ্রদ অভিনয় উপহার দিয়েছেন।
পাতা ঝরার দিন
অ্যালজাইমার রোগে ভোগা বাবা মেয়ের রাগ ভাঙাতে রসগোল্লা আনতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে ফেরার পথ। বিশাল এ শহরে বাড়ি ফিরবে কি করে? এমনই হৃদয়গ্রাহী এক গল্প নিয়ে হাজির হয়েছে রেদোয়ান রনি। বাবা, মেয়ের উদ্বিগ্নতা ক্যামেরার ভাষায় মেকি ভাবে হাজির হয় নি। যথেষ্ট ইন্টেন্সিটি ছিল রেদোয়ান রনির গল্প বলার ধাঁচে আর পরিচালনায়। শেষটা তিক্ত কিন্তু মধুর। যথেষ্ট অনুনাদী কাজ। মেয়ে ঈশিতা, বাবা হাসান ইমাম দুজনেই খুব ভালো অভিনয় করেছেন।
জুনিয়র আর্টিস্ট লতিফ
আমাদের নাটক বা সিনেমায় জুনিয়র আর্টিস্ট কতটা নিগৃহিত সে গল্প তুলে ধরা হয়েছে সুমন আনোয়ারের এই টেলিফিল্মে। অভিনয়ের জন্য সবকিছু উজাড় অথচ তারা দিনশেষে নিগৃহিতই থেকে যায়। নাটক, সিনেমার শ্যূটিং এর পেছনের নানান অসংগতি আর বিড়ম্বনার গল্পকে যথাযথ হাস্যরস দিয়ে উপস্থাপন ছাড়াও জুনিয়র আর্টিস্টদের প্রতি অবহেলার বাস্তবিক গল্প বলেছেন সুমন আনোয়ার। মূল চরিত্রে আছেন আফরান নিশো। লতিফ চরিত্রে অনবদ্য। শেষটায় গিয়ে নাটকের টোন খানিকটা ইমব্যাল্যান্স এবং ধরাবাঁধা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া খুবই ভালো কাজ।
লালাই
এক অবলা জীবের প্রতি ভালোবাসার বেদনাময় উপাখ্যান। এ গল্প ছেলেবেলার বিটিভি সময়কার নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেকদিন পর এমন গল্পের নাটক দেখলাম। খুবই ইমোশনাল। মূল চরিত্রে আফরান নিশো এই ঈদের অন্যতম সেরা অভিনয় দিয়েছে। পরিচালক মাবরুর রশীদ বান্নাহ’র সরল কিন্তু অনুনাদী গল্পবলিয়ে আর পরিচালনায় বেশ ভালো একটা নাটক, লালাই।
দানব
সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই টেলিফিল্ম। এক কুখ্যাত ডাকাতকে ঘিরে। ডাকাতের চরিত্রে মোশারফ করিম পারফেক্ট। চরিত্রটিকে যেভাবে ছাঁচে ফেলা হয়েছে আর মোশারফ করিম যে অভিনয়টা দিয়েছেন নাটকের নামকরণ স্বার্থক। ভয়ংকর দানবই মনে হয়েছে তার চোখ আর শারীরি ভাষায়। চরিত্রে যতটুকু ইন্টেন্সিটি ছিল তা মেলে ধরতে চিত্রনাট্যে আরেকটু জোর দেওয়ার দরকার ছিল। তবে আজাদ কালামের পরিচালনায় ভালোই হয়েছে এই টেলিফিল্ম। মোশারফ করিমের সেরা কাজ।
রং বদল
রং বদলের এই খেলায় কে কখন হারিয়ে যায় তা কে বা জানে ? এক স্যান্ডেল বিক্রেতার গল্প। অনেকটা স্লাইস অফ লাইফ ধরনের কাজ। প্রথম দুই অ্যাক্টেই কমিক ভাইবের সরব উপস্থিতি ছিল। কালার গ্রেডিং, সম্পাদনা, আবহসঙ্গীত এ সে ভাইব ভালোই ধরা দিয়েছে। ফাইনাল অ্যাক্টও ভালোই। নিশো, মেহজাবিন, তাদের ছেলে শরিফুল পরিবারের সবাই দারুণ করেছে। ক্যাচি গল্পবলিয়ে আর ডিসেন্ট পরিচালনায় বেশ ভালোই হয়েছে এই নাটক।
সেলিব্রেটিবিডি/ এনজেটি/ এমআরটি
Discussion about this post