রাকিবুল হাসান রাকিব:
মাবরুর রশীদ বান্নাহ প্রায়শ নিজেকে ভাঙতে চেয়েছেন গল্পের আলোকে সোশাল ম্যাসেজ দেওয়ার প্রচেষ্টায়। এবারের ঈদেও বেশকিছু নাটক নির্মাণ করেছেন তিনি। তন্মধ্যে আলোচিত ও প্রশংসিত কাজগুলো হলো-
লালাই
‘রাস্তায় আমার বসত আজি/ সমাজ আমায় ডাকছে পাজি/ আভাব আমায় দিচ্ছেনা ছাড় / দারিদ্রতা ছাড়ছেনা ঘাড়।’
কোরবানীকে কেন্দ্র করে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই মেতে উঠি ঈদের পূর্ব মুহূর্তে গরু কেনার নানান পরিকল্পনা। কিন্তু গরু বিক্রেতা সেই কৃষক যদিও তার আর্থিক অনটন কিংবা সামান্য লাভের কথা ভেবে তার স্নেহের গরুটিকে বিক্রি করতে প্রস্তুত; সে কি আদৌ মন থেকে সুখী হতে পারে কি? তাদের হাহাকারের শব্দ প্রায়শ ভেসে উঠে সরল আর্তনাদের মধ্য দিয়ে। তখন অবুঝ নিরীহ পশুটিও মালিকের বেদনায় অশ্রুজলে ভেসে উঠে; গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। চোখ থেকে সমগ্র মুখমন্ডল ব্যাপী। এই দৃশ্যের দর্শক আমরা অনেকেই হয়েছি। তবুও কি আমরা কখনো চিন্তা করতে পারি কি, সামান্য পশুর সাথে কিভাবে এত একাত্বতা কাজ করতে পারে কোন মানুষের? যদি এতই বা টান থাকে, তাহলে তার আদরের পশুকে কেনই বা বিক্রি করতে এতটা উদগ্রীব হয়ে আছে?
মেয়েটার অসুখ তাই বলে কি পারতো না কোন সাহেবের শরণাপন্ন হতে! তা নিয়ে কবিতার কিছু চরণ মনে পড়ে- আমার মেয়েটার অসুখ,/ সাহেব যদি পারেন,/ দশটা টাকা বেশি দিয়েন।’
সাহেব রাগে গর্জে উঠেন বলে- “রাখো মিয়া ওই সব চুতিয়া আলাপ,/ ভাওতাবাজির জায়গা পাওনা আর!/ শালা আবার ভদ্র ভাষায়কথা বলে!” কৃষকের সাথে তার লালিত পশুর সম্পর্কটা হয়তো বা মুখরোচিত অনেকের জানা। অথবা আপনারা গুটিকতক লোকেরা স্ব-চোক্ষে সে যাত্রার পথিক ছিলেন। আসুন আপনাদের দারিদ্রতায় জরাজীর্ণ জীবনের মধ্য দিয়েও গরুর সাথে তার মালিকের জীবনচিরতের চিত্র প্রদর্শিত করবো।
কালু পরিচয়ে একেবারে সাদামাটা একদম চুপচাপ সহজ-সরল স্বভাবের কৃষক। দীর্ঘদিন কোমড়ে ব্যাথার কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। কিন্তু তার রোগ ব্যধি কিংবা পারিবারিক কোন মায়া তাকে মোটেও অমনোযোগী হতে দেয়নি তার লালাইয়ের অমায়িক দেখাশোনার কাছ থেকে। এসবে ভীষণ আপত্তি তার বউ কলির। কেননা তার মতে, লালাই তো সামান্য গরু। সে গরুর এতোই বা কিসের যতœ নিতে হবে যে তার নিজের শরীর অথবা পরিবারের কথা বাদ দিয়েও তার কথা ভেবে চলতে হবে। কালুর মেয়ে খুশীর দীর্ঘদিন জ্বরে থাকার পর, চিকিৎসার অভাবে বড় রোগ দেখা দেয়। এতে অনেক টাকার প্রয়োজন পড়ে। পরিবারের মত থাকলেও কালু কোনমতেই রাজি নয় তার লালাইকে বিক্রি করায়। সে যেভাবেই হোক মেয়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার ব্যবস্থা করবে। বান্নাহ পরিচালিত নাটকটি গল্পধারায় ফুটে উঠেছে এমনই লাখো লাখো কৃষকের মর্মকথা। তিনি তার নির্দেশনার শৈলীতে তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের আলোকে।
প্রত্যেকটি সিকোয়েন্সে আপনার কেবল হৃদয় ব্যথিত হবে না, সেই সাথে বেদনার করাল ঘ্রাসে অশ্রুজল আপনা-আপনি চোখ গড়িয়ে পড়তে থাকবে। সত্যি ইমোশানগুলো যতই চেষ্টা করেন, তা আর দমিয়ে রাখা যাবে না৷ কারণ প্রদর্শিত চরিত্র কালু অন্য কেউ নয়, আমি-আপনি বা আমাদের পরিচিত কোন লোকের জীবনচরিত। এই কান্না কিসের জানেন!!! আনন্দের বা বেদনার নয়। এটি আমাদের অসহায়ত্বতার জানান রূপে ফুটে উঠেছে। গল্পটির সংস্পর্শতা উপলব্ধি করার দরুণ, সত্যি পাথর হৃদয় ও যেন মোমের মত গলে বেদনার কান্না স্বরুপ নীরব হাহাকারের সৃষ্টি করবে।
মূল চরিত্রে থাকা নিরীহ প্রাণীর ব্যবহারটা ক্যামেরা কাজ বা গরুটিকে প্রদর্শিত করার ভঙ্গি লা-জবাব। আফরান নিশো কালু চরিত্রে এভাবেই মিশেছেন যেন তিনি তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছে স্ব-ঘোষিত কৃষক সম্প্রদায়ের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে চরিত্রালোকে। তার নানান এক্সপ্রেশন কিংবা ডায়ালগ ডেলিভারি এমনকি তার বডি পোর্শান সত্যি প্রশংসিত। নিশোর হাহাকারের বেদনায় দর্শক বাধ্য হাজারো চেষ্টায় জমিয়ে থাকা অশ্রু জল হয়ে গড়িয়ে পড়ার। তানজিন তিশার কাজ ও যথেষ্ট ভালো ছিল। নিশো-তানজিন তিশার মধ্যকার মধুর-রিক্ততার সম্পর্ক দারুণভাবে ফুটে উঠেছে; তাদের মধ্যকার রসায়নের মাধ্যমে।
‘দারিদ্রতা বুঝি, প্রভুর প্রিয় অতি,/ সানন্দে সঁপে দেয়, প্রিয়তম প্রতি।/ ধৈর্য চেয়ে বড় দান, নাহি কিছু আর,/ তাই প্রভু খুলে দিলো, মুক্তির দ্বার।’নিঃসন্দেহে এই ঈদের অন্যতম সেরা কাজ। এমনকি বান্নাহ ভাই পরিচালিত এবারের সেরা কাজ ও বটে।
বেডসিন
‘কিসের এত আনন্দ,/ কিসের এত উল্লাস !/ একদিন তোমায় মরতে হবে,/ হতেই হবে লাশ!/ যাদের তুমি আপন ভাব,/ তারা সবাই হবে পর !/ আপন বলতে থাকবে শুধু নেক আমল,/ আর মাটির অন্ধকার কবর !”
শব্দগত অর্থে মস্তিষ্কের কোণে হয়তো বা জন্ম নিতে পারে কামুক কোন দৃশ্যের চিন্তাচেতনা। অথচ বিছানা বলতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত শব্দের পঙ্কিমালা বিন্যস্ত করলে উন্মোচিত হবে মূল রহস্য। শৈশবকাল থেকে বৈবাহিক জীবন কিংবা মৃত্যুর পরে জীবনের এই মূল্যবান সময়টুকুতে বিছানাকে কেন্দ্র করে রচিত। যেথায় জীবনের সুখ-দুঃখের মর্মকথা রূপায়িত হয় নানান ধাপে ধাপে।
জীবনের এই ধাপগুলো বর্ণিত হয়েছে ইধহহধয ভাই নির্মিত নাটকে। যেথায় গল্পের প্রাক্কালে স্বামী-স্ত্রীর বাসর রাতের মুহূর্তের খুনসুঁটির মধ্য দিয়ে গল্প তার আপন গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। যাকিনা প্রত্যেক পরতে পরতে বিছানাকে কেন্দ্রীভূত করে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের রিক্ততা কিংবা মধুরতা অথবা আনন্দ-বিষাদের মুহূর্তগুলো উন্মোচিত হবে জীবনের নানান সময়কালে। বিভিন্ন স্তবকে আপনার বা আমারই জীবনের রূপরেখা রূপায়িত হবে গল্পের আলোকে। যার শেষ গন্তব্য চিরন্তন নিষ্ঠুর সত্যতার মাধ্যমে বিলীন হয়ে যায়।
মূল চরিত্রে থাকা ইরফান সাজ্জাদ ও তানজিন তিশা দুজনের কাজ বেশ ভালো। তাদের মধ্যকার কেমেষ্ট্রিও খুব সুন্দরভাবে গল্পে ফুটে উঠেছে।
‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।/ মসজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,/ মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।/ জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।/ ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।”
‘ছেলেরাও কাঁদে’
শৈশবকাল থেকে কিংবা সিনেমায় আমরা শুনে এসেছি অথবা দেখে এসেছি ছেলেদের কখনো কাঁদতে নেই। কান্না হচ্ছে নারীর ভূষণ। ছেলেরা কোনকিছুতেই কাঁদে না। অথচ বাস্তবতাটা কি?? একবার ভেবেই দেখুন। জীবনের নানান স্তবকে আমরা ছেলেরাও বিভিন্ন পরতে ভেঙে পড়েছি কিংবা কখনো বয়সটাও ততটা ম্যাচিউর ছিলো না তেমন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার। নিজের কষ্ট হয়তো বা দম আটকে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর বেদনায় চোখের কোণে আনমনে জল চলে আসে। তখন ঠিকই লোকচক্ষুর আড়ালেই হোক, অঝোরে চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে চোখের জল।
গল্পটি বেড়ে উঠেছে, উপর দিয়ে শক্ত আমাদের পুরুষ সত্ত্বার মনের মধ্যকার বাস্তবিক রূপকে। যাকিনা গল্পকথকের জীবনের নানান ধাপের আলোকে রিক্ততার জীবনেও মোরা খুঁজে পাই জীবনের কলতানের বেদনার হাহাকার। তখনো কি আমরা নিজেদের অশ্রুকে দমিয়ে রাখতে পারি কি? তার জানান গল্পের আলোকে পরিবেশিত হয়েছে।
মাবরুর রশীদ বান্নাহ’র নির্দেশনায় কাজটি রূপরেখা ফুটে উঠেছে নারিকেল স্বভাবাপন্ন আমাদের পুরুষসত্ত্বার ভেতরকার সরল মানুষটির রূপকে। যেকিনা বেদনার সুরে হয়তো বা বিলাপ করে কাঁদেনি কিন্তু ঠিকই অশ্রুজলে ভিজে গেছে তার মুখশ্রী কিংবা চোখের কোণায় দখল করে নিয়েছে, অপার রিক্ততার হাহাকার।
আফরান নিশোর গল্পের মধ্য দিয়ে পরিবেশনের প্রচেষ্টায় তিনি দিয়েছেন নিজের সাবলীলতা অভিনয়ের নৈপুণ্যতা। যেথায় অভিনেতা নিশোকে নিশো নয়, বরং আমি বা আপনি রূপে পর্দায় দেখতে পাবেন। সেথায় অভিনেতা শতভাগ সার্থক। তানজিন তিশা ও নিশোর রসায়ন বেশ ভালোই জমেছে।
নাটকে পরিবেশিত সোশ্যাল ম্যাসেজ কি ছিল তা দর্শকের কাছেই প্রশ্ন থাকুক। তবে গল্পের মতোই জীবনের ঐরূপ পরিস্থিতিতে আপনি সত্যি পারবেন না নিজের অশ্রুকণাকে দমিয়ে রাখতে।
‘আমার পক্ষে তোমাকে রাখা সম্ভব না’
জানেন আমি প্রায় আম্মুর সাথে ঝগড়া এই বলে যে, আম্মু তোমার মেয়ে নাই দেখে আমাকে দিয়ে ঘরের টুকিটাকি এত কাজ করাও? কেন আম্মু? আমি কি মেয়ে? এসব তো মেয়েদের কাজ। আম্মু কখনো হেসে কিংবা জেদ করে বলে, এই গৃহিণী যদি একদিন তার কাজ না করে তোদের কি পরিস্থিতি হবে জানিস?
তুমি নারী তুমি রবে রান্নার দুয়ারে/ যদিও তুমি রও অসুখ-বিসুখে/ তবুও শান্তি নেইকো তোমার কপালে/ জানিতে নাহি পারি মোরা/ তুমি আছো মোদের কতটা অক্ষিজোড়া
মেয়ে মানুষ দুর্বল ভেবে আমরা যা পারি তার উপর অন্যায়-অবিচার চালিয়ে থাকি। ঘরের বউ তো গৃহিণী, তার দায়িত্ব ই তো কাজ করার। কিন্তু সেই গৃহিণীর কি কাজের কোন ছুটি পেতে নেই? আমরা কি পারি সাহায্যের দুটো হাত সেদিকে বাড়িয়ে দিতে? চাইলেই পারি। কিন্তু অহম সে সাহায্যের পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
যুথি তার পারিবারিক জীবনে অবহেলিত এক তরুণী। প্রেমিকের জোরে পালিয়ে বিয়ে করলেও তার দুরাশায় অন্ত যায় না শ্বশুরবাড়িতে এসেও। কেননা তার প্রেমিক ও চাচার বাড়িতে লালিত। সেথায় গৃহিণী হিসেবে নিজের পরিচয় সানন্দে মেলে ধরলেও পরিবারের লোকেরা তার গুরুত্বের অবলোকন তো নয় বরং ধিক্কারের রিক্ততার কথার ঝুলির শিকার হয়। উত্তোরণের উপায় আছে কি?
মাতৃ-গর্ভে নারীর আসন/ বাবা বলে একি!/ নারী বাবার হত্যা শিকার/ মাতা করবে কি?/ স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুুরুষ গর্ভে নারীর লাশ,/ পরাধীন আজ নারী মানুষ/ অকালে প্রাণ-নাশ!
মাবরুর রশীদ বান্নাহপরিচালনায় আবারো সমাজের এক দৃশ্যের জানান গল্পের আলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন, সত্যি তাতে মুগ্ধ হতে হয়। গল্পটি আমার আপনার পরিবারের এমন লাখো নারীর জীবনের মর্মকথা ব্যক্ত হয়েছে।
অভিনয়ে তানজিন তিশা ও অপূর্ব দুজনের কাজই সাবলীল লেগেছে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনীত অভিনয়শিল্পীদের কাজ ও দারুণ ছিল। অথচ আমাদের মুখ থেকে বলা মায়ার বুলিতেও তারা আবেগী হয়ে পড়ে….
রানীর মতন বসবো রতন আসনে,/ বাঁধিব তোমারে নিবিড় প্রণয় শাসনে;/ দেবীর মতন পুরাব তোমার বাসনা।’ সত্যি গল্পটি আমায় অনুপ্রাণিত করেছে এমনকি ভবিষ্যতেও করে যাবে। আপনিও অন্ধকারকে দূর করে আলোয় আলোকিত করে তুলুন ভালোবাসার মানুষটিকে মমতায়।
এছাড়াও মানুষ হবো এবং জীবন এখানে এমন কাজগুলো ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও প্রত্যাশা রইলো উনার কাছ থেকে ভিন্ন ধারার সুকৌশলী নির্মাণে ভালো গল্পের কাজ খুঁজে পাবো।
সেলিব্রেটিবিডি/আরএইচআর
Discussion about this post