২০২৪ সালে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চলতি বছরে ৪ হাজার ৮১৩ জনের মৃতদেহ দেশে ফেরত এসেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫.৭ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক, বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে যে, এই মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রবাসে মৃত শ্রমিকদের মধ্যে ৩১ শতাংশের মৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ দুর্ঘটনায় এবং ১৫ শতাংশ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারিয়েছেন। বাকি অংশের মধ্যে ২৮ শতাংশের মৃত্যু ‘স্বাভাবিক’ এবং অন্যরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী ৫৫৪ জনের গড় বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর। সংলাপে জানানো হয়, গত ১২ বছরে প্রবাসে মৃত্যু হয়েছে ৪০ হাজার ৭১৩ জন বাংলাদেশি কর্মীর। এত কম বয়সে মৃত্যুর বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের মতে গভীরভাবে অনুসন্ধানযোগ্য। বিশেষ করে যখন দেখা যায়, বিদেশে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সত্ত্বেও তারা সেখানে গিয়ে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
সংলাপে বলা হয়, মৃত্যুসনদে স্বাভাবিক মৃত্যু উল্লেখ থাকলেও অনেক মরদেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এমনকি ৪৮ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুসনদে দেওয়া কারণকে বিশ্বাস করেন না। এ অবস্থায় দেশে ফেরত আসা মরদেহে ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
এছাড়া মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াতেও রয়েছে নানা অনিয়ম ও অসংবেদনশীলতা। ঢাকার বিমানবন্দরে মরদেহ গ্রহণের সময় ৮০ শতাংশ পরিবার প্রশাসনিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “এতো মানুষের মৃত্যু ঘটছে, অথচ সরকার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অনেক সময় মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও সনদে তা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এত অল্প বয়সে কর্মজীবনের শুরুতেই মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক এবং এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীলতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
নিবন্ধে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, ময়নাতদন্তের জন্য লাশ রাখতে বিমানবন্দরে হিমাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত কর্মীর পরিবারকে প্রবাসী কর্মীদের পুনরেকত্রীকরণ কর্মসূচিতে যুক্ত করা যেতে পারে। বিদেশে পাঠানোর আগে কর্মীদের প্রশিক্ষণে বিভিন্ন রোগের বিষয়ে ধারণা দেওয়া উচিত।
সংলাপে যোগ দেন ২০১৭ সালে জর্ডানে মারা যাওয়া নরসিংদীর সাজেদার ভাই নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, জর্ডানে এক বছর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন সাজেদা। হঠাৎ করেই ভবন থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়। মৃত্যুর যথাযথ কারণ জানতে চান তিনি।
বক্তারা বলেন, নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। আর উচ্চ অভিবাসন খরচ তুলতে গিয়ে বাড়তি পরিশ্রম করেও না পারার হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেন পুরুষ কর্মীরা। ৮ ঘণ্টা কাজের বদলে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। মানুষ হিসেবে যাচ্ছেন একজন কর্মী, মারা গেলে ফিরে আসছেন কার্গো হয়ে। বিশ্বের সব দেশেই মৃতদেহকে কফিন হিসেবে কার্গোর মতো করে পরিবহন করা হয়। তবে ঢাকা বিমানবন্দরে এখন মৃতদেহ হস্তান্তর আগের চেয়ে সহজ ও দ্রুত করা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য সেলিম রেজা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। বিশেষ করে তাঁদের দ্রুত কিডনি নষ্ট হওয়ায় মুমূর্ষু রোগীর থেকে কিডনি নিয়ে রেখে বিক্রির অভিযোগ আছে। কোনো কর্মীর অঙ্গ যেন বিক্রি না হয়, সেটির বিষয়ে দূতাবাসকে সতর্ক থাকতে হবে।
ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান বলেন, মৃত্যুর যথাযথ কারণ খুঁজতে হলে অবশ্যই ময়নাতদন্ত করতে হবে। যে বয়সে মারা যাচ্ছেন, তাতে প্রতিটা মরদেহের ময়নাতদন্ত করা উচিত। দূতাবাসেরও এটা তদন্ত করে দেখা উচিত, কেন কম বয়সে কর্মীরা মারা যাচ্ছেন।
বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, কর্মীদের বিদেশ পাঠানোর আগে মধ্যপ্রাচ্যের স্বীকৃত মেডিকেল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। এ খাতে অরাজকতা আছে। টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা করানোর অভিযোগ আছে। তাই স্বাস্থ্য পরীক্ষা যথাযথ হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা। এতে আরও বক্তব্য দেন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক এ টি এম আব্দুর রউফ মণ্ডল, বিএমইটির পরিচালক মাসুদ রানা প্রমুখ।
Discussion about this post