দেশের শ্রমবাজার এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগের লোকজন। যে কারণে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য বিভিন্ন দেশে শ্রম বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। উন্মুক্ত হচ্ছে না নতুন শ্রমবাজার। শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা যেমন কমছে তেমনি কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সবচাইতে খাতটিতে পঙ্গু করে রাখার নেপথ্যে দায়ী হিসেবে উঠে এসেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব রুহুল আমিনের নাম। তিনি গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের তদবিরে এ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। জনশক্তি রপ্তানী ও কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও মন্ত্রণালয়ে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের দোসর ও শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ হেলালের নিকটাত্মীয় হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বসেন রুহুল আমিন।
তার স্ত্রীর বড়ভাই এমরান হোসাইন বিগত নির্বাচনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রকে পক্ষে রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর রুহুল আমিন প্রায় তিন মাস মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে শ্রমিক নিয়োগানুমতি বন্ধ রাখেন। তিনি ভিসাপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ দাবি করেন। তার অদক্ষতা ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতার কারণে গত ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়া যেতে পারেনি প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক। তার কারনে মালয়েশিয়ার বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশী শ্রমিকরা। বহু শ্রমিক নিঃস্ব হয়ে পড়ে। যেসব সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি ওই শ্রমিক সঙ্কটের দায়ী ছিল তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেননি সচিব। অনেক ক্ষেত্রে তিনি মনগড়াভাবে মূল এজেন্সির মালিকদের জরিমানা করেন। তিনি বায়রার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রিয়াজ হোসেনের রিয়াজ ওভারসিজের নিবন্ধন স্থগিত করে দেন।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে যখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে প্রবাসীরা বিক্ষোভ করে। সচিব রুহুল আমিনের পররামর্শে ওইসব দেশে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিশেষ করে দুবাইতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করে বিক্ষোভ করায় ৫৭ জন শ্রমিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। সচিব রুহুল আমিনের ইন্ধনে ওইসব প্রবাসীদের সাজা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হয়ে কাজ করেন এবং বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের হুমকি দেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়েও তিনি ওইসব শ্রমিকদের কারামুক্ত করা এবং দেশে ফেরত আনার কাজে নানানরকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন বিষয়টি সমাধানের জন্য বলা হয় তখন সচিব বিষয়টিকে ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে সময়ক্ষেপণ ও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
সচিব নতুন শ্রমবাজার খোঁজার বিষয়টিকে গুরুত্ব না নিয়ে বরং যেসব দেশে আমাদের বাজার উন্মুক্ত রয়েছে সেগুলো বন্ধ করার অপচেষ্টা করছেন। সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপেও বাংলাদেশী কর্মী রপ্তানি বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে তার ইন্ধন থাকার অভিযোগ রয়েছে। তার কারণে সিঙ্গাপুরেও নতুন শ্রমিক যাওয়া কমেছে। দেশটিতে ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৩৮৩ জন ও ২০২৩ সালে ৫৩ হাজার ২৬৫ জন গেলেও চলতি বছর গেছেন ১৪ হাজার ৯৬৪ জন।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, সচিব রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর। তিনি আগের মতোই আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং তাদেরকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছেন। বায়রার আওয়ামী লীগ-সমর্থক একাধিক নেতা তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেন এবং তিনি অবৈধভাবে তাদেরক নানান সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে।
অভিযোগ থেকে আরো জানা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিক গিয়েছে মোট ৩০ লাখ ৫ হাজার ৩৫৩ জন। সেখানে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে শ্রমিক গিয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৮০ হাজার ৪১৯ জন। এদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় বিশেষ ব্যবস্থায় যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বাদ দিলে মূলসংখ্যা তলানি গিয়ে ঠেকে। আবার প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে স্থবিরতা। গত বছর প্রবাসী রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৯৪২ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার সেখানে চলতি বছর সেটা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৩১৭ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলারে।
সচিব রুহুল আমিন প্রতি মাসে শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন জনকে মাসোহারা দিতেন বলেও অভিযোগ আছে। তিনি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা এ খাতে চাঁদা তুলে প্রায় শেখ হাসিনা, শেখ হেলাল ও জয়ের কাছে পাঠাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি শেখ হেলাল, শেখ হাসিনা ও শেখ জুয়েলকে নিয়মিত বাগবাটোয়ারা করে দিতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে মন্ত্রণালয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। বর্তমানেও সংশ্লিষ্ট কর্তাদেরকে তিনি ভুল বার্তা দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয়ে সচিব রুহুল আমিনের বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইলে ফোন দেয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি।
সচিবের বিষয়ে জনশক্তি রপ্তানি কারকদের সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ও এইচ আর ডেভলপমেন্ট সেন্টারের (আরএল-৪৫২) চেয়ারম্যান ফকরুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি এ সেক্টরকে আরো সম্প্রসারণ করতে পারেন। এ সেক্টরের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও অনেক বিজ্ঞ মানুষ। তারও এ সেক্টরকে সম্প্রসারণ করতে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইউরোপে শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে যেসব দেশে আমাদের এম্বেসি নেই সেসব দেশে এম্বেসি খুলতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের যেনো ইন্ডিয়ায় যেতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচার আমল থেকে মালয়েশিয়াভিত্তিক যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেটা ভাংতে হবে।
Discussion about this post