নীলা। নামের সঙ্গে জীবনের গল্প অনেকটাই পরিপূরক। নীলা নামের বিশেষায়িত অর্থ সফল। আবার ভাগ্য রাশি বদলাতে নীলা পাথরের জুড়ি মেলা ভার। তবে নামের অর্থের নীলা আর ব্যক্তি নীলার সফলের গল্পটা কিন্তু ভিন্ন। ব্যক্তি নীলা অবৈধ উপায়ে রাতারাতি ধনকুবের বনে গেছেন। নীলার ডানে-বাঁয়ে থাকত সুঠাম নারী দেহরক্ষী। আর পেছনে বিশাল নারীর বহর।
নীলার প্রভাবে গোটা রূপগঞ্জ জিম্মি ছিল। চাউর আছে—নীলার নীল দংশনে অতীতে অনেক তরুণ-যুবকও ধ্বংস হয়েছেন। নানা কেলেঙ্কারি আর অঘটনের পর ফটিক নামের একজনকে বিয়ে করেন নীলা। সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই নীলা। নীলার উত্থানপতনে গাজীর আশীর্বাদ বড় ভূমিকা রেখেছে।
এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের এক সময়ের মাঠকর্মী নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি টাকা তছরুপ, ভুয়া প্রকল্প, সরকারি টাকা লোপাট আর ক্ষমতার বদৌলতে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার রয়েছে পূর্বাচল উপশহরে এক ডজন প্লট, বিঘায় বিঘায় জমি, ঢাকায় আলিশান পাঁচতলা বাড়ি, ঢাকার অভিজাত শপিংমলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম এবং চীন ও সিঙ্গাপুরেও রয়েছে ব্যবসা।
১০ বছরের ব্যবধানে ফুলে-ফেঁপে ওঠা তৎকালীন বিএনপি নেত্রী ফেরদৌসী আলম নীলার থাবা থেকে বাদ যায়নি শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জমিও। এ জমিতে গড়ে তুলেছেন ‘নীলা মার্কেট’। নীলা মার্কেটের আড়ালেই চলে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। মার্কেটের আশপাশ এলাকাগুলো এখন অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা।
মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পাশাপাশি উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ায় প্রশাসন তার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আর স্থানীয় সাধারণ মানুষ নীলা নাম মুখে আনতে গিয়ে জবুথবু হয়ে পড়েন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জের ইউসুফগঞ্জ ভোলানাথপুর এলাকার আজিমউদ্দিন ভূঁইয়ার মেয়ে ফেরদৌসী আলম নীলা। তাদের গোটা পরিবারই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। হাইস্কুল জীবন থেকেই এ নীলা ছিল বাউন্ডুলে। স্কুল ও কলেজ জীবনে নীলার দংশনে অনেক তরুণ-যুবকের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়।
ভাগ্যের বিধিবাম! অনেক তরুণ-যুবক তার রূপের আগুনে পুড়লেও ফটিকের ফিটিংবাজির কাছে ধরাশায়ী হন এ নীলা। দুজনই এনজিও সংস্থা ব্র্যাকে চাকরি করার সুবাধে গোপন প্রণয় হয় তখন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পূর্বাচলের ‘নীলা মার্কেট’ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এতবার শিরোনাম হয়েছে যে, এখন মার্কেটটি একনামে চেনেন সবাই। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট দখল করে নীলা দাঁড় করিয়েছেন ওই মার্কেট। এর পাশেই প্লট দখল করে বানিয়েছেন পূর্বাচল ক্লাব। ক্লাবের পিলেচমকানো নাম ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী শাহ আলম ফটিক আর দেবর আনোয়ার হোসেন ক্লাবটির দেখভাল করেন।
পূর্বাচলে প্রতিবন্ধীদের খেলার জায়গা দখল করে বানিয়েছেন লেডিস ক্লাব, পূর্বাচল কনভেনশনের ৭৬ কাঠার প্লট এখন তার কবজায়, পূর্বাচল ক্লাবের সদস্যপদ কেনাবেচা হয় মোটা অঙ্কের টাকায়। শীতলক্ষ্যার তীরে প্লট দখল করে চলছে কয়লা-পাথর-বালুর কারবার, মন্দির-শ্মশানের প্লটে উঠিয়েছিলেন দোকান আর ইউসুফগঞ্জ খালের ওপর উঠেছে নীলার বাড়ি। ক্ষমতার দাপটে স্থানীয় ইউসুফগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদ নীলা আঁকড়ে রেখেছেন এক যুগ। এখনো রয়েছেন স্বপদে।
প্রতিবন্ধীদের খেলার জায়গায় লেডিস ক্লাব, পূর্বাচল ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩০৫ নম্বর রোডে প্রায় তিন বিঘা জমি প্রতিবন্ধীদের খেলার মাঠ হিসেবে সংরক্ষণ করেছিল রাজউক। ওই প্লটের দুই বিঘা জমি নীলা দখল করে তৈরি করেছেন পূর্বাচল লেডিস ক্লাব। চারপাশে সীমানা দিয়ে ভেতরে বানানো হয়েছে সুইমিংপুল, অফিস কক্ষ, ব্যায়ামাগারসহ কয়েকটি অবকাঠামো। নীলা নিজেই ক্লাবের সভাপতি। ক্লাবটির সদস্যপদ বিক্রি চলছে ৩ লাখ টাকায়। আজীবন সদস্যপদ ৪ লাখ আর দাতা সদস্যপদ বেচাকেনা হচ্ছে ৬ লাখ টাকায়। এরই মধ্যে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২০০। ক্লাব তদারকির দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের কাছে সদস্যপদ কেনার ব্যাপারে কথা বলতে নীলার স্বামী শাহ আলম ফটিকের মোবাইল ফোন নম্বর দেন। ফোন করা হলে শাহ আলম ফটিকের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, লেডিস ক্লাবের পাশেই ১০ কাঠার মতো আয়তনে প্রতিবন্ধীদের খেলার জায়গা হিসেবে একটি সাইনবোর্ড আছে। স্থানীয়রা জানান, ক্লাবের জায়গার প্রায় পুরোটাই প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে একটি কনভেনশন সেন্টারের জন্য জমি বরাদ্দের আবেদন করেন কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া, মোজাহারুল হক ও হুমায়ুন কবির। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর প্লটের জামানতের ১৫ লাখ টাকাও জমা দেন তারা। বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর ১ নম্বর সেক্টরের ২০৪ নম্বর রোডের ৩ নম্বর প্লটটি কনভেনশন সেন্টারের জন্য বরাদ্দ দেয় রাজউক। প্লটের আয়তন ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠা। প্লটটির বর্তমান বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বরাদ্দ পেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির ১০ কোটি টাকা জমা দেন সংশ্লিষ্টরা। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা হঠাৎ জানতে পারেন, ফেরদৌসী আলম নীলা ‘পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেড’ নাম দিয়ে ওই প্লটটি দখল করে নিয়েছেন। আর রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত করে নতুন নামে সেটা রেজিস্ট্রির অনুমতিপত্রও রাজউক থেকে বের করেছেন। পুরো প্লটে দেয়াল দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন নীলা। এর মধ্যেই মূল বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা বিষয়টি নিয়ে রাজউকে যান।
সরেজমিন দেখা যায়, পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের প্লট দখল করে নীলার তৈরি করা অবকাঠামোগুলোর ইট-বালু-সুরকি প্লটের মধ্যে পড়ে আছে। আরেক পাশের দেয়াল এখনো রয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, প্লটটি এখনো নীলার নিয়ন্ত্রণেই আছে।
দম্পতির ক্লাব বাণিজ্য: পূর্বাচলের ১২ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডের ৪ নম্বর প্লটটি রাজউক বরাদ্দ দিয়েছিল পূর্বাচল ক্লাবের নামে। প্লটটির আয়তন ১৪৭ দশমিক ১৩ কাঠা। ওই জমির বর্তমান বাজারদর প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ক্লাবের জমির বিপরীতে ১৪ কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসী আহমেদ নীলা। তার স্বামী শাহ আলম ফটিক হলেন কোষাধ্যক্ষ। নামসর্বস্ব একটি কমিটি থাকলেও পুরো নিয়ন্ত্রণই নীলা দম্পতির। বর্তমানে ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি হচ্ছে ২৫ লাখ টাকায়। এরই মধ্যে প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। তবে ক্লাবের সদস্যদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।
সদস্যদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠার পর গত আট বছরে ক্লাবের কোনো সাধারণ সভা হয়নি। ক্লাবের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব কখনোই সদস্যদের দেওয়া হয় না। ক্লাবের ভেতরের জায়গায় প্রতিদিনই সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এ খাত থেকেই প্রতি মাসে অন্তত ৪০ লাখ টাকা আয় হয় ক্লাবের। এই টাকার পুরোটাই আত্মসাৎ করে নীলা দম্পতি। কখনোই কোনো হিসাব দেওয়া হয় না। ক্লাবের এক কর্মচারী জানান, তাদের ক্লাবের এক বেলার ভেন্যু ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্যান্ডেল তৈরিসহ অন্য খরচ যিনি ভাড়া নেন, তাকে বহন করতে হয়।
ক্লাবের আরেক সদস্য বলেন, ক্লাবের ভেতরে দেয়াল ঘেঁষে থাই পেয়ারার বাগান করেছেন নীলা। এই পেয়ারা বিক্রির টাকাও নিজের কাছে রাখেন তিনি। আরেক সদস্য বলেন, প্রথম দিকে সদস্যপদের ফি ছিল ৫ লাখ টাকা। কিছুদিনের মধ্যেই সেটি ১০ লাখ টাকা করা হয়। এখন ২৫ লাখ টাকা। এক হাজার সদস্যের কাছ থেকে গড়ে ১৫ লাখ টাকা নিলে মোট টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ১৫০ কোটি টাকা। জমির দাম পরিশোধ ও শুধু একতলা একটি অফিসকক্ষ ছাড়া কার্যত ক্লাবের জন্য কোনো কাজই করা হয়নি। যে অবকাঠামো করা হয়েছে, তাতে এক থেকে দুই কোটি টাকা খরচ হতে পারে। বাকি প্রায় ১৩৪ কোটি টাকার হদিস নেই। কখনো সাধারণ সভা না হওয়ায় সদস্যদের ধারণা, এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি: ১৯৬৭ সালে স্থাপিত ইউসুফগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজটি পূর্বাচল প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরে। পূর্বাচল প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সেখানে ১৪৭ কাঠা জায়গা বরাদ্দ দেয় রাজউক। পাশাপাশি একটি তিনতলা ভবনও তৈরি করে দেয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ১ হাজার ২০০। ২০১০ সাল থেকে ফেরদৌসী আহমেদ নীলা ওই ইউসুফগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদ দখল করে আছেন। প্রতি বছর স্কুলের নামে আশপাশে থাকা খালি প্লটগুলোতে কোরবানির বিশাল পশুর হাট বসান নীলা। এ থেকে কয়েক কোটি টাকা আয় করেন তিনি। স্কুলের নামে হাটটি বসালেও কানাকড়িও স্কুলের তহবিলে দেন না।
কলেজের দাতা সদস্য দীন মোহাম্মদ দিলু বলেন, পাঁচ বছর আগে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন নীলা আর কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি থাকতে পারবেন না। আদালতের সেই আদেশও আমার কাছে আছে।
উচ্ছেদের পরও নীলা মার্কেট: পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের পাশে প্রায় ৪০ একর জমি রাখা হয়েছে শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামের জন্য। সেই জায়গা দখল করে নীলা গড়ে তোলেন ‘নীলা মার্কেট’। সেখানে দোকান তৈরি করে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বরাদ্দও দেন তিনি। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে একাধিকবার এসব মার্কেটের অংশবিশেষ উচ্ছেদ করে রাজউক। একদিকে উচ্ছেদ, অন্যদিকে ফের দোকান নির্মাণ করে চালান ব্যবসা। সর্বশেষ রাজউক স্টেডিয়ামের জায়গাটি টিন দিয়ে ঘিরে দেয়। এরপর আশপাশে থাকা খালি প্লটগুলো দখল করে আবারও শুরু হয়েছে নীলা মার্কেটের কার্যক্রম। সরেজমিন দেখা যায়, আবারও সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নামের খাবার হোটেল, কাঁচাবাজারসহ দোকানপাট। দোকানভেদে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া আদায় হচ্ছে নীলার নামে। ইউসুফগঞ্জে শ্মশান ও খালের জমি দখল করে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন নীলা। এরপর সেটির একাংশ ভেঙে দেয় রাজউক। সম্প্রতি আবার সেটি গড়ে তুলেছেন। ১ নম্বর সেক্টরের ইছাপুর মৌজার মন্দির ও শ্মশানের জন্য জায়গা দিয়েছিল রাজউক। সেই জায়গার একাংশ ও পাশের খালের জায়গা দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন নীলা।
তবে পূর্বাচলের সাবেক প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক কালবেলাকে বলেন, পূর্বাচল লেডিস ক্লাব নামে কোনো জায়গা রাজউক বরাদ্দ দেয়নি। যদি এটা কেউ করে, তাহলে উন্মুক্ত স্থান বা অন্যের প্লট দখল করা হয়েছে।
এসব ব্যাপারে নীলা কালবেলাকে বলেন, আমি সাত সাতবারের জনপ্রতিনিধি। খারাপ করলে আর জনগণ আমাকে সাতবার জনপ্রতিনিধি বানাতেন না। অনেক কাজ করেছি সাধারণ মানুষের জন্য। এসব কারণে একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি প্রতিবন্ধীদের জায়গা দখল করিনি। পাশের একটি আবাসিক প্লট আমার বাবার। সেটিতে ক্লাবের কার্যক্রম চলছে। আমি কারও প্লট দখল করিনি।
Discussion about this post