বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের জনশক্তি রফতানি খাত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বহির্বিশ্বে এখন বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তবে এর মধ্যেও বিমানবন্দরসহ অবকাঠামোগত নানা দুর্বলতায় প্রবাসে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের ভোগান্তি বাড়ছে। একই সঙ্গে তত্পর হয়ে উঠেছে দালালসহ প্রতারক নানা চক্র। ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যেও এসব দুর্বলতার কারণে সামনের দিনগুলোয় দেশের জনশক্তি রফতানি খাত নিয়ে নানা ধরনের বিড়ম্বনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছর দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম ছিল বৈদেশিক জনশক্তি রফতানি খাত। তবে বর্তমানে সে পরিস্থিতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে খাতটি। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে সোয়া চার লাখেরও বেশি। দীর্ঘ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি খুলেছে আরেক বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবও এখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রমিক নিচ্ছে শুধু বাংলাদেশ থেকেই।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও (ইউএই) বাংলাদেশীদের ভিসা পাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ হয়েছে। গত মাসেই ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ কর্মী জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন, যা করোনা মহামারীর মধ্যে নতুন রেকর্ড। জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশ যদি চলমান সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোয় আরো কয়েক গুণ কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে।
যদিও খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সম্ভাবনাময় এসব শ্রমবাজারকে কাজে লাগাতে খুব একটা প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বাড়তি চাহিদার কারণ দেখিয়ে এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির প্রলোভন এবং নিয়ন্ত্রণহীন দালাল চক্রের প্রতারণা। সব মিলিয়ে লাগামহীনভাবে বাড়ছে বিদেশগামী কর্মীর অভিবাসন ব্যয়। অন্যদিকে বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর দুর্বলতাও প্রতিনিয়ত বিদেশগামী কর্মীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংস্কারকাজের জন্য প্রতিদিন রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত সব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হচ্ছে। নতুন হাইস্পিড কানেক্টিং ট্যাক্সিওয়ে বানানোর জন্য এ অবস্থা চলবে আগামী ছয় মাস। এতে এক প্রকার বিপর্যয় নেমে এসেছে ফ্লাইট শিডিউল কার্যক্রমেও।
আবার করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কার্যক্রম। এতে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর। বিমানবন্দরটিতে যাত্রী চাপ বাড়লেও রাতে কার্যক্রম না চলায় ফ্লাইট বাড়াতে পারছে না এয়ারলাইনসগুলোও।
এদিকে ইউএই সরকারের শর্ত অনুযায়ী গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রার ৬ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে যাত্রীদের করোনা পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। বিমানবন্দরে এ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬। এসব প্রতিষ্ঠানের বুথে নমুনা দিতে যাত্রীদের দুর্বিষহ ভোগান্তি পোহাতে হয়। নির্ধারিত সময়ে কভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়ায় প্রায়ই ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা। রাতে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় যাদের সকালে ফ্লাইট রয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে আগেই এসে উপস্থিত হচ্ছেন বিমানবন্দরে। এমন যাত্রীও পাওয়া যায়, যারা বিমানবন্দরে বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষা করাতে ফ্লাইটের ১২ ঘণ্টা আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে তাদের টার্মিনালেই রাত কাটাতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারীর আগে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ফ্লাই দুবাই, এয়ার অ্যারাবিয়াসহ আরো কয়েকটি এয়ারলাইনস সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করত। এসব এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম থেকেই বিদেশগামী কর্মীদের দুবাই, আবুধাবি ও শারজাহ যাওয়ার সুযোগ ছিল। এমনকি ওইসব গন্তব্যে ট্রানজিট নিয়ে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গন্তব্যেও গিয়েছেন বাংলাদেশী কর্মীরা। বর্তমানে এ বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চাপ পড়ছে শাহজালাল বিমানবন্দরের ওপরই।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মী গিয়েছিলেন ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন। আর চলতি বছরের (জানুয়ারি-নভেম্বর) ১১ মাসেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৫ জনে। তাদের মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গিয়েছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ১৪ জন বা ৭৬ শতাংশ। এছাড়া ওমানে ৪০ হাজার ৮৬ জন, সিঙ্গাপুরে ২১ হাজার ৩৩৯, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ২৭৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৮৪৫ ও কাতারে ৯ হাজার ৭২৮ জন কর্মী গিয়েছেন।
বৈদেশিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে এখনো কর্মীদের নানামুখী ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আবার প্রায়ই দেখা যায়, বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার বিষয়ে যথাযথভাবে অবগত নন। এমনকি সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনার ঝক্কিঝামেলা এড়াতে অনেকে দালালের শরণাপন্ন হন। এতে গমনেচ্ছুদের বড় একটি অংশ বিদেশযাত্রা করতে গিয়ে প্রতারণার ঝুঁকিতে পড়েন।
মালয়েশিয়া থেকে ছুটিতে দেশে এসে আটকে পড়া যশোরের শাহীন বলেন, দেড় বছর ধরে বাড়িতে আছি। কর্মস্থল থেকে কাজে যোগ দেয়ার জন্য নির্ধারিত সময় দেয়া হয়েছে। তবে কভিড সনদ সংগ্রহ ও পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় বেশকিছু কাগজ পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি। কাগজপত্র সংগ্রহে অন্যদের ভোগান্তি দেখে আমার ভয় বাড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার, বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে পুরোদমে চলছে কর্মী রফতানি। আসন সংখ্যার কয়েক গুণ যাত্রী বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে আকাশপথে অস্বাভাবিক হারে ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানো দেশী-বিদেশী সব এয়ারলাইনস। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো জানিয়েছে, গত নভেম্বরেও ঢাকা থেকে সৌদিগামী ফ্লাইটগুলোর একমুখী টিকিট পাওয়া যেত ৪০-৫০ হাজার টাকায়। বর্তমানে তা ৭০ হাজার টাকার নিচে পাওয়াই দুষ্কর। অন্যদিকে ঢাকা-দুবাই রুটের একমুখী ভাড়া বর্তমানে ৮০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। আর ঢাকা-মাস্কাটের একমুখী ভাড়াও ৭০ হাজার টাকার বেশি। এসব রুটের ভাড়া গত মাসেও ছিল ৪০ হাজার টাকার মধ্যে।
ভুক্তভোগী বিদেশীগামী কর্মীদের অভিযোগ, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতি হয়নি। গত অক্টোবরেও ভাড়া অনেক সহনশীল ছিল। মূলত গত মাস থেকেই অস্বাভাবিক হারে ভাড়া আদায় শুরু করেছে এয়ারলাইনসগুলো।
টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি ও আসন সংকট নিরসনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে সম্প্রতি চিঠিও দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি অব বাংলাদেশ (আটাব)। চিঠিতে আটাব বলেছে, সম্প্রতি দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ কারণে প্রবাসী যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এভাবে ভাড়া বাড়ানোকে অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত মনে করে আটাব।
আশার বিষয় হলো, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত চারটি ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য এরই মধ্যে বিমানবন্দরের বরাদ্দকৃত স্থানে মেশিন স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে আবারো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, সেনেগাল, বুরুন্ডি, সেশেলস, মালয়েশিয়ার সারওয়াকে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। কভিডের কারণে দেশটি বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না। এর বিপরীতে চাহিদা বেড়েছে বাংলাদেশী কর্মীদের। দেশটিতে বেসরকারি খাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কোটা ৩০-৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে চার হাজার ভিসা দিচ্ছে সৌদি দূতাবাস। গত নভেম্বরে নতুন প্রবাসী কর্মী হিসেবে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে কেবল সৌদি আরবেই গেছেন ৭১ হাজার ৭২৫ জন বাংলাদেশী কর্মী।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ইউএই বাংলাদেশীদের জন্য ভিসাপ্রাপ্তি এখন অনেক সহজ করেছে। নিয়মিত প্রবাসী কর্মীর পাশাপাশি ভ্রমণ ভিসায়ও দেশটিতে বাংলাদেশী কর্মীদের গমন বেড়েছে।
Discussion about this post