হাসনাত জাহান সিফাত : ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে নিজের আনন্দ অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া। ত্যাগের সুমহান মহিমা নিয়ে আমাদের মাঝে বারবার ফিরে আসে পবিত্র ঈদুল আযহা। একে আমরা কোরবানির ঈদও বলে থাকি। কোরবান শব্দটি আরবি। যার উৎপত্তি কুরবুন বা কুরবানুন থেকে। যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা, ত্যাগ করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর দেয়া বিধান অনুযায়ী পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে। আমাদের এ ত্যাগ, উৎসর্গ হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সুরা আল-কাউসারে বলেন- “তোমরা রবের জন্য সালাত আদায় করো ও কোরবানী করো।”
আমাদের মধ্যে অনেকে নিজের পোষা প্রাণী দিয়ে কোরবানি করে আবার অনেকে হাট থেকে কিনা প্রাণী দিয়েও কোরবানি করে। নিজের পোষা প্রাণী দিয়ে কোরবানি করলে ত্যাগের যে আনন্দ অনুভব করা যায়, বাজারে কেনা পশু দিয়ে কোরবানি করলে তেমন আনন্দ উপভোগ করা যায় না। তাই পোষা প্রাণী দিয়ে কোরবানি করলে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ বেশি থাকে। আসলে শুধু পশু কোরবানি দিলেই কোরবান সম্পূর্ণ হয়না। তার সাথে নিজের মনে বসবাস করা পশুকেও কোরবান দিতে হবে। আমাদের এ ত্যাগ বা উৎসর্গ হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। সুরা আন’আমের ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন “বলুন! নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু একমাত্র বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।”
মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই কোরবানির বিধান প্রচলন ছিলো। ইতিহাসের প্রথম কোরবানি ছিলো পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ. এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিলের। এ কোরবানির বর্ণণা সূরা মায়িদার ২৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে “আর তাদেরকে আদম আ. এর দুই পুত্রের কাহিনী সঠিকভাবে শুনিয়ে দাও। তারা দুইজন কোরবানি করলে একজনের কোরবানি কবুল করা হলো আরেক জনের হলো না।”
তবে আমরা যে কোরবানি পালন করি তার প্রেক্ষাপট এর থেকে ভিন্ন। আমরা কোরবানি পালন করে থাকি হযরত ইব্রাহীম আ. এর সুন্নাত হিসেবে। এই প্রসঙ্গে রাসুল সা. কে এক সাহাবী প্রশ্ন করেন- “হে আল্লাহর রাসুল! এ কোরবানি কী? জবাবে রাসুল সা. বললেন এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম আ. এর সুন্নাত।” (ইবনে মাজাহ ও আহমাদ) আর হযরত ইব্রাহীম আ. ছিলেন সর্বাবস্থায় আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা। যার স্বীকৃতি আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে নিজে দিয়েছেন। সুরা আন-নাহলের ১২০-১২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ বলেন- “প্রকৃত পক্ষে হযরত ইব্রাহীম একাই ছিলো একটি পরিপূর্ণ উম্মাত, আল্লাহর হুকুমের অনুগত এবং একনিষ্ঠ। সে কখনো মুশরিক ছিলো না। সে ছিলো আল্লাহর নিয়ামতের শোকরকারী। আল্লাহ্ তাঁকে বাছাই করলেন এবং সরল সঠিক পথ দেখালেন। দুনিয়ায় আমি তাঁকে কল্যাণ দান করলাম এবং আখিরাতে সে নিশ্চিত সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
হযরত ইবরাহীম আ. নিঃসন্তান ছিলেন। মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে তিনি বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভ করেন। যার নাম হযরত ইসমাঈল আ.। হযরত ইসমাঈল যখন কৈশোরে উন্নীত হোন তখন তাঁর পিতা হযরত ইবরাহীম আ. স্বপ্নে হযরত ইসমাঈল আ. কে কোরবানি করার আদেশ প্রাপ্ত হোন। যখন তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে স্বপ্নের কথা বললেন, তখন হযরত ইসমাঈল আ. বিনীত ভাবে তাঁর পিতা হযরত ইবরাহীম আ. কে বললেন “প্রিয় বাবা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা আপনি সম্পাদন করুন। আমাকে ধৈর্যশীলদের সাথে পাবেন।” (সুরা আস-সাফফাত:১০২)। হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করলেন এবং স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আ. কে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে মিনায় গিয়ে উপস্থিত হোন। তারপর হযরত ইসমাঈল আ. এর হাত-পা বেঁধে ফেললেন। এরপরে জবেহ করার উদ্দেশ্যে তাঁর গলায় ছুরি চালালে প্রথমে ব্যর্থ হোন। পরে হযরত ইসমাঈল আ. এর পরামর্শে তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে চোখ বন্ধ করে হযরত ইবরাহীম আ. তাঁর ছেলের গলায় ছুরি চালান। কিন্তু চোখ খুলে হযরত ইবরাহীম আ. হযরত ইসমাইল আ. এর স্থলে দেখতে পেলেন একটি দুম্বা জবেহ হয়ে পড়ে আছে। আর তাঁর পাশেই প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল আ. দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত ইবরাহীম আ. আনুগত্যের যে উপমা পেশ করলেন তা আল্লাহ্ তায়ালা মিল্লাতে ইবরাহীমের জন্য এক মহান ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে স্বরণীয় করে রাখলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন “মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি।” (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)
আমাদের জন্য এ কোরবানির গুরুত্ব অপরসীম। আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল্লাহ্ সা. বলেন- “কোরবানির দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় হলো রক্ত প্রবাহিত করা তথা কোরবানি করা।” আবু হুরায়রা রা. হতে অন্য এক হাদিসে রাসুল সা. বলেন- “কোরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবান করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।”
শুধু পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে না। পশু জবেহ করার সাথে সাথে নিজ মনে বাস করা পশুকেও কোরবানি দিতে হবে। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ্যে যারা গরীব-অসহায় যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের মাঝে নিজের কোরবানির গোশত বিলিয়ে দিয়ে ধনী-গরীব পরস্পর পাশাপাশি দাঁড়াতে হবে। ঈদ এলেই আমাদের সকলের মনে আনন্দের ঝর্ণা প্রবাহিত হয়। কারণ ঈদের জামাতে ধনী-গরীব, কালো-সাদা সকলেই একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করে। প্রত্যেকেই আবদ্ধ হয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। সকলে ঈদ আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেয় নিজেদের মধ্যে। আর এজন্যই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই।’
আমরা যদি কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে শামিল হতে পারি তবে এর থেকে জীবনে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে। প্রত্যেক বান্দারতো এটাই চাওয়া। এ পরম সৌভাগ্য যে অর্জন করবে তাঁর জন্যইতো ঈদ আনন্দ।
লেখক, শিক্ষার্থী,ফাজিলপুর ওয়ালিয়া ডিগ্রী মাদ্রাসা, ফেনী সদর, ফেনী।
Discussion about this post