স্বাভাবিক কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার প্রবাসী কর্মী মারা যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দেশটির রাজধানী আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাস ও দুবাইস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট আলাদাভাবে মৃত প্রবাসীদের এনওসি (অনাপত্তি পত্র) ইস্যু করে থাকে। এই হিসেবে মৃত ব্যক্তির তালিকা, বিতরণ ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র থাকে আলাদা আলাদা। ২০২০-২১ সালের তালিকা অনুযায়ী শুধুমাত্র দুবাই ও উত্তর আমিরাতে মারা গেছেন ৫৯৫ জন প্রবাসী কর্মী। এরমধ্যে ২০২০ সালে ৪৫০ জন ও ২০২১ সালে এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১৪৫ জন কর্মী। আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাসও বছরে অন্তত পাঁচ শতাধিক মৃত কর্মীর এনওসি দিয়ে থাকে। মৃত কর্মীদের কারো কারো নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান বা নিয়োগকর্তার কাছে থেকে যায় দেনাপাওনা।
দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত প্রবাসীদের মামলাগুলো গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ভুক্তভোগীর পরিবার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (ক্ষমতাপত্র) প্রদানের পর বাংলাদেশ মিশনগুলো তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে কাজ করে। দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেট জানায়, প্রতিবছর অন্তত ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে লেবার উইং। আদায়কৃত ক্ষতিপূরণের অর্থ মৃতব্যক্তির উত্তরাধিকারীর হিসাব নম্বরে বা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রেরিত ব্যাংক হিসাব নম্বরে প্রেরণ করে বাংলাদেশ মিশন।
দূতাবাস ও কনস্যুলেটের তথ্য মতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে নানাভাবে ১১৩ জন প্রবাসীর ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়। আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেট ১৬ জন প্রবাসীর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় করে সাড়ে চার কোটি টাকা। একই অর্থ বছরে চাকুরিচ্যুত ৫০জন কর্মীর বেতন বকেয়া বাবদ ক্ষতিপূরণ আদায় করে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ জন মৃত প্রবাসীর নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান ও স্পন্সর থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে ২ কোটি ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়াও ২০১৯ সালে দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেট প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় করে ৮ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ১৬১ জন কর্মীর বকেয়া বেতন বাবদ ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় ২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। মহামারি করোনার প্রভাবে দেশটিতে আদালতের কার্যক্রম সীমিত থাকায় কিছু মামলা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আবুধাবি দূতাবাসের অধীনে ৮৯ টি ক্ষতিপূরণ মামলা এখনো প্রতিক্রয়াধীন আছে।
জানা গেছে, প্রবাসী কর্মীদের ক্ষতিপূরণ আসে দুটি আলাদা প্রক্রিয়ায়। বকেয়া বেতন বা সার্ভিস বেনিফিট ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বা হত্যা। কোনো কর্মী হত্যার শিকার হলে রক্ত ঋণের বিনিময়ে আসামিকে মওকুফ করা যায়। এ ধরনের মামলায় দেড় থেকে দুই লাখ দিরহাম পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আসে। মামলার রায় হলে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে লাগে ছয় মাস থেকে একবছর। আবার ক্ষতিপূরণ মামলার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ভুক্তভোগীর পরিবার বিভিন্ন সময় ল’ ফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যান। আদায়কৃত ক্ষতিপূরণের শতকরা একটি অংশ প্রদান শর্তে ল’ ফার্মগুলো কাজ করে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে। ভুক্তভোগী পরিবার থেকে ল’ ফার্মগুলোকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (ক্ষমতাপত্র) প্রদান করলে মামলার নিষ্পত্তির পর তারা ক্ষতিপূরণের ১০ থেকে ২০ শতাংশ অর্থ কেটে রেখে বাকি টাকা ভুক্তভোগীর পরিবারে প্রদান করে থাকে।
এই বিষয়ে দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটের লেবার কাউন্সিলর ফাতেমা জাহান বলেন, সরকারিভাবে মিশনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিলে ক্ষতিপূরণের পুরো অর্থই ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে পৌঁছে যায়। নানা সময় অভিযোগ আসে, দ্বিতীয় পক্ষ বা তৃতীয় পক্ষকে ক্ষমতাপত্র দেয়ার পর মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণের অর্থ পান না ভুক্তভোগীর পরিবার। এদের বেলায় আমরা আইনগত সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেও পারি না। তবে মিশনকে দায়িত্ব দিলে মামলা পরিচালনাসহ যাবতীয় খরচই বহন করে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। ক্ষতিপূরণের অর্থও পৌঁছে যায় ভুক্তভোগীর পরিবারে।
আবুধাবি দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর আবদুল আলিম মিয়া জানান, কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ১৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা দূতাবাসে জমা রয়েছে। উত্তরাধিকারীর ব্যাংক হিসাব নম্বরের জন্য এই অর্থ প্রেরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আবদুল আলিম মিয়া বলেন, স্বাভাবিকভাবে মৃতের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা হতে স্থানীয় শ্রম আইনানুসারে দূতাবাস হতে মৃতদেহ দেশে প্রেরণের ছাড়পত্র ইস্যু করার পূর্বেই ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করা হয়। অপরদিকে দুর্ঘটনায় মৃতদের ক্ষেত্রে পরিবার হতে দূতাবাসের নামে ক্ষমতাপত্র প্রদান করা হলে দূতাবাস সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় করে। ক্ষতিপূরণ প্রাপ্যতা সাপেক্ষে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ব্যাংক হিসাব নম্বরে সেগুলো প্রেরণ করা হয়।
Discussion about this post