কামরুল হাসান জনি
‘আর কত দিন থাকবেন ?’
‘একবারেই চলে এলেন নাকি?’
‘শুনেছি ক্যানসেলে চলে এসেছেন, ঘটনা সত্য নাকি?’
‘কি ভাই, আরো থাকবেন নাকি ?’
‘ছুটি ক’মাসের ?’
‘এবার মনে হয় একটু বেশি থেকে যাচ্ছেন ?’
– কি মনে হয় ! প্রশ্নগুলো খুব সহজ সরল ? একজন প্রশ্নকর্তা খুব সহজে সদ্য প্রবাস ফেরত একজন প্রবাসীকে এই প্রশ্নগুলো করতে পারেন ? হয়ত আপনারও উত্তর -নিশ্চয়ই! কিন্তু সবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক উত্তর নাও হতে পারে। কারণ, কেউ আসেন ছুটিতে, ঘুরতে। কেউবা একবারেই। ক্ষেত্র বিশেষে উত্তরগুলো ভিন্ন। ওই প্রবাসীর মনের অবস্থা অথবা চেহারায় ফুটে উঠা দৃশ্যমান চিত্র অতিসহজে ধরার সাধ্য নেই প্রশ্নকর্তার। স্বাভাবিক উত্তরে ঢেকে যায় অনেক না বলা কথা। এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মনে হয়- আহ, আপন গৃহেই স্বল্পকালীন অতিথি আমরা! আমাদের যেতে হবে। এখানে আমাদের থাকতে নেই, থাকা যায় না, যাবে না। যেদিন প্রথম প্রবাসে পা রাখা হয়, সেদিন থেকে দেশে থাকার অধিকার হারান একেকজন প্রবাসী। হয়ে উঠেন টাকার মেশিন! অথচ প্রত্যেক প্রবাসী একেকটি অসমাপ্ত উপন্যাস। যে পাতা ধরেই শুরু করা হোক, এর আদিঅন্ত খুঁজে দাঁড়ি টানা সাধারণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। খন্ড খন্ড চিত্রায়নে তবুও অনেকে চেষ্টা করেন জীবন জীবিকার খোঁজে পরবাসে দিন কাটানো মুসাফিরদের ঘড়ির কাঁটা ক্ষয় করা সময়গুলো কলম কাগজে লিপিবদ্ধ করার। সেসব গল্পগুলো তাঁরাই অনুভব করার শক্তি-সামর্থ রাখেন, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে কখনো না কখনো পরবাসে দিনাতিপাত করেছিলেন। এছাড়া খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি পাওয়া যেতে পারে যাঁরা ‘প্রবাসী’ শব্দটি এবং এর ভেতর বাস করা মানুষটিকে বুঝতে সক্ষম। কারণ, এদের যতটুকু দেখা যায়, এরচে বেশি আড়াল করেন তারা। আড়ালে রাখেন স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্খা আর না পাওয়ার অনুভূতিগুলো। খুব করে প্রকাশ-প্রচার করেন একটুখানি আনন্দ অথবা লালিত স্বপ্নের খন্ডিত বাস্তবচিত্র। সব কিছুর ভিড়ে পরিবারই এদের একমাত্র আস্থা ও ভরসার জায়গায়। দিন শেষে তাদের জন্যেই তো নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছেন ওরা। লাখো-কোটির ভিড়ে এদেরও শ্রেণি বিন্যাস আছে। এরা বাঁচে ধাপে ধাপে, স্তরে স্তরে। দৃষ্টি যদি মধ্যপ্রাচ্যের উপর রাখি, এখানে প্রায় সত্তর শতাংশ প্রবাসীই শ্রমিক। বাকি ত্রিশ শতাংশ বিভিন্নভাবে উচ্চ পর্যায়ে কাজ করেন। ওই সত্তর ভাগ আবার কত যে স্তরে ভাগ করা, তা কি আমার মত একজন সাধারণ প্রবাসীর নির্ণয় করা সম্ভব!
বিএমইটি’র হিসাব বলছে ১৯৭৬ সালে সৌদি আরবে যান মাত্র ২১৭ জন আর ২০১৮ সালে অক্টোবর পর্যন্ত মক্কা-মদিনার দেশে যান ২ লাখ ৬ হাজার ৭৬৮ জন। ওই সময়ের মধ্যে সর্বমোট সৌদি আরব প্রবাসী হয়েছেন ৩৬ লাখ ৩৯ জন। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৯৭৬ সালে পাড়ি জমান ১ হাজার ৯৮৯ জন আর ২০১৮ সালে অক্টোবর পর্যন্ত যান ২ হাজার ৫৯৯ জন। মাঝের সময়টাতে ভিসা বন্ধ থাকায় যাতায়াত কমলেও বর্তমানে ভিজিটে প্রবেশ করছেন লাখো নতুন মুখ। যারা কর্মের সন্ধানে মূলত আসছেন দেশটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও পরিসংখ্যান বলছে রেমিটেন্স প্রেরণের দিক থেকে এই দুই দেশের প্রবাসীরাই সেরা। ছোট পরিসরে শুধু বিদেশ যাত্রার হিসাবটুকু উল্লেখ করা হলো এখানে। তবে এদের মধ্যে অনেকেই ফিরেছেন আপন গৃহে, অনেকেই আবার চলে গেছে না ফেরার দেশে। আসা-যাবার এই সময়কালে কত সুখ স্মৃতি, কত স্বপ্ন, স্বপ্নের বাস্তবায়ন অথবা চোখের সামনেই স্বপ্ন ভঙ্গ ! সব মিলিয়েই প্রবাস জীবন।
জীবনের স্বাদ বলতে এদের কাছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা আর তাদের একটুখানি প্রেরণাই যথেষ্ট। ব্যাস, নিজের সবটুকু বিলেই যান অকাতরে। ওই যে সত্তর শতাংশের কথা বলছিলাম, এরা যে পরিমাণ শ্রম দেয়, ঘাম ঝরায় ঠিক সমপরিমাণ ভরসা খুঁজেন দেশে ও পরিবারে। চব্বিশ ঘন্টার এক চতুর্থাংশ এরা কর্মস্থলে সময় দেন। ভোর চারটা থেকে রাত আটটা, কখনো কখনো নয়টা বা এরও বেশি। কাজ করেন, খাটেন। লক্ষ্য তাদের মাস শেষের বেতন। সে বেতনে ভর করে চলে পরিবারের সকল সদস্য। বিনোদন বলতে বাজার-সদাই আর মোবাইল ফোন। এভাবে কাটতে থাকে প্রবাসে এক প্রকার শৃঙ্খল জীবন। বিশৃঙ্খলা শুধু একটি মাত্র জায়গায়। তাও নিজের জন্যে নয়! গ্লানি মোছা অর্থ কোন পথে পাঠাবেন, কিভাবে পৌঁছাবেন প্রিয়জনের হাতে! এই দ্বিধায় হালকা পাতলা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন এরা। সহজ পথ বলতে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে যে খরচটুকু দিতে হয়, হুন্ডি কিংবা অন্যকোনো কায়দায় মোবাইল ব্যাংকিং এ দিলে সেই খরচের তুলনামূলক পরিমাণ কমে যায়। খরচ বাঁচাতে অবৈধ পন্থায় পা বাড়াতে হয় তাদের। পরিবারের কথা ভেবে, দু’পয়সা লাভের চিন্তা করে এরা ছোট অন্যায়টুকুতে বড় ক্ষতি করেন রাষ্ট্রের। অথচ বাংলাদেশ সরকার চাইলে ব্যাংকে প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর উপর আরোপকৃত অর্থের পরিমাণ আরো কমিয়ে দিতে পারে অথবা একেবারেই মকুব করে দিতে পারে এই অর্থ। দেশের বাইরে থেকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূলে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠাতে পারবে, এমন একটা সিদ্ধান্ত যদি নিয়েই নেয় সরকার, তবে অপরিপূর্ণ শৃঙ্খল জীবনে পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা ফিরবে এই সত্তর শতাংশের। এছাড়াও একটু সচেতনতা, একটু পরিচ্ছন্নতা, একটুখানি ভ্রাতৃত্ববোধ, একে অন্যের প্রতি সম্মান আর ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারলে এই সত্তর শতাংশ প্রবাসী একদিন পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারবে।
লেখক : ইউএই প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল।
Discussion about this post