আর্থিক খাতে বহুল আলোচিত লুটেরার নাম পি কে হালদার। এই ব্যক্তি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকাকালে জাল এনআইডি ব্যবহার করে ভুয়া দুই ব্যক্তির নামে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। তাঁরা হলেন জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইরফান আহমেদ খান ও ভার্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ফয়সাল মুস্তাক। বাস্তবে ইরফান আহমেদ খান ও ফয়সাল মুস্তাক নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বই নেই। এই দুই নামে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এনআইডি ও ট্রেড লাইসেন্সের ঠিকানাগুলোও ভুয়া।
জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নামের আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ১০০ কোটি টাকার মতো ভুয়া ঋণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জাল এনআইডিতে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার ঋণের নামে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা।
একইভাবে কাগুজে প্রতিষ্ঠান দ্রিনান অ্যাপারেলস, ওয়াকামা লিমিটেড, পি অ্যান্ড এল, কণিকা, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, দেওয়া শিপিং, আরবি, বর্ণ, নিউট্রিক্যাল, মুন, আর্থস্কোপ, এমটিবি মেরিনসহ দুই ডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়ে পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা মোট চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মাত্র দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। আবদুল আলিম চৌধুরী নামের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে পি কে হালদার দুবাইয়ে পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিষয়টির অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে ঋণের নামে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারে টাকা সরিয়ে আত্মসাৎ করেন।
ঋণ জালিয়াতিতে পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম চৌধুরী। এই আব্দুল আলিম চৌধুরী নিজের জন্য পি কে হালদারের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ঋণ ইস্যু করে নেন। বিনিময়ে তিনি পি কে হালদারকে বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতি ও বিদেশে অর্থপাচারে সহায়তা করেন। এই আব্দুল আলিম নিজেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। মন্টিনিগ্রোতে ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ করেন আব্দুল আলিম চৌধুরী। ওই হোটেলে পি কে হালদারের শেয়ার রয়েছে।
আব্দুল আলিম চৌধুরীর মাধ্যমে পি কে হালদার দুবাইয়ে রায়েল আমরো লিমিটেড নামের এক হিসাবে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন। এ ছাড়া আব্দুল আলিম চৌধুরী কক্সবাজারের রেডিসন ব্লু হোটেলের একক মালিক ছিলেন। পরে হোটেলটি পি কে হালদারের কাছে ৮৪ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন তিনি। একই কায়দায় ভুয়া এনআইডিতে দ্রিনান অ্যাপারেলস নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ভুয়া ঋণ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। কোনোরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই ওই ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এই কাগুজে কম্পানির এমডি ছিলেন আবু রাজীব মারুফ। কিন্তু চেকে স্বাক্ষর করেন রাজীম সোম, যার এনআইডি ভুয়া ছিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখায় এই ঋণের টাকাগুলো স্থানান্তর হয়, তার এনআইডিও ভুয়া। তখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি ছিলেন রাশেদুল হক। এ ছাড়া জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুবিলি রোড ও স্টেশন রোড শাখায় একাধিক ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিল। একইভাবে বিডি ট্রেডিং নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খোলা হয়, যার মালিক ইরফান। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
Discussion about this post