আর্লি টু বেড এণ্ড আর্লি টু রাইজ’
মানুষ আজ সর্বত্র অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়েছে। অন্যের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরনে নিজের স্বকীয় অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের মত আমরা সচেতনরাও রাতে দেরিতে ঘুমাই এবং সকালে দেরিতে উঠি। নিয়মিত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন এবং তারপর শারিরীক ব্যায়াম করেন এমন সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। শতকরা হিসেবে ১℅ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অথচ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি করা অতি আবশ্যক এবং না করাটা মারাত্মক ঝুঁকি।
প্রবাদ আছে- সুস্বাস্থ্য, সম্পদ আর জ্ঞানের পুর্ব শর্ত হচ্ছে জ্বলদি ঘুমাতে যাওয়া এবং জ্বলদি ঘুম থেকে উঠা। যারা রাতে জাগার এবং সকালে দেরিতে উঠার বদভ্যাস গড়ে তুলেছেন তাদের জন্য সতর্কবার্তা জারি করছেন যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক। তারা ৩৮ থেকে ৭৩ বছর বয়সী ৪ লাখ ৩৩ হাজার মানুষের উপর একটি গবেষণা চালিয়েছেন। তারা গবেষণাটা করেছেন ৪ ক্যাটাগরির মানুষের উপর।
১. নিয়মিত সকালে উঠেন
২. মাঝে মাঝে সকালে উঠেন
৩. মাঝে মাঝে দেরি করে ঘুমান
৪. নিয়মিত রাত জাগেন
যুক্তরাজ্যের সুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোনলজি বিভাগের অধ্যাপক জন রিচার্ডসন বলেন, আমরা দেখেছি যারা যারা দেরি করে ঘুম থেকে উঠেন তারা নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগেন। তাদের গড় আয়ুও নিয়মিত সকালে উঠা মানুষের চেয়ে ৬.৫ বছর কম। গবেষণা বলছে, যারা নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে উঠেন তাদের অকাল মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। আর যাদের দেহ কোন নিয়ম মানে না তাদের এ ঝুঁকি বাড়তেই থাকে।
ডা. পিরেজ লেভি, যিনি যুক্তরাজ্যের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, তিনি বলেন, রাতে জাগার বদভ্যাস যারা গড়ে তুলেছেন তাদের ৯০ ভাগই মানসিক রোগের শিকার। ৩০ শতাংশের থাকে ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। এছাড়া স্নায়ুবিক সমস্যা থেকে শুরু করে অন্তরের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
গবেষকদের পরামর্শ হচ্ছে- সুস্থ থকার জন্য নিয়মিত করে একই সময় ঘুমানো এবং ঘুম থেকে উঠা জরুরি। ঘুমের সময় মোবাইল ও ল্যাপটপ ব্যবহার না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আলোচ্য গবেষণা থেকে পরিস্কার বোঝা যায় আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ কতটা জরুরি। এটা জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন।
এবার আসি ইসলামের দিকে। এ ব্যাপারে ইসলাম বিস্তারিত কথা বলেছে। ইসলাম সকালে ঘুম থেকে উঠার ব্যাপারে সম্যক গুরুত্ব দিয়েছে। এটিকে জীবীকা প্রশস্ত হওয়ার একটি পন্থা বলে ঘোষণা করেছে। এ সংক্রান্ত কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো তুলে ধরছি।
প্রিয়নবী (সা.) ভোরবেলার কাজে বরকতের জন্য দোয়া করেছেন। হযরত সাখার আল-গামেদি (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এ দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরুকে বরকতময় করুন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০৬)।
এ জন্যই রাসুল (সা.) কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। বর্ণনাকারী বলেন, হযরত সাখার (রা.) তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম ভোরবেলা শুরু করতেন। এতে তার ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয়। তিনি প্রভূত প্রাচুর্য লাভ করেন।
হজরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসুল (সা.) আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং বললেন, মা মণি! ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কেননা আল্লাহ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রিজিক বণ্টন করে থাকেন।’ (আত-তারগিব, হাদিস নং : ২৬১৬)।
সকালবেলার সময়টা আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় যে, তিনি এ সময়ের শপথ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শপথ প্রভাতকালের, যখন তা আলোকোজ্জ্বল হয়। নিশ্চয় জাহান্নাম ভয়াবহ বিপদগুলোর অন্যতম। (সুরা : মুদ্দাসিসর, আয়াত : ৩৩-৩৫)।
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘শপথ তাদের, যারা অভিযান বের করে প্রভাতকালে।’ (সুরা : আদিআত, আয়াত নং : ০৩)।
প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সকালবেলায় রিজিকের অন্বেষণ করো। কেননা সকালবেলা বরকতময় ও সফলতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়। ’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস নং : ৬২২০)।
উপরের আয়াত-হাদীসে সকালের সময়ের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সকালের সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে রিজিক সম্প্রসারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
রাসুলুল্লাহ (সা) সকালের সময়টাকে বরকতময় বলেছেন। অর্থাৎ সকালের সময়ে যে কাজ করা হবে তা বরকতময় হবে অথবা তাতে বরকত ঢেলে দেয়া হবে।
কাজ না করে যারা এই সময়টাতে ঘুমাবে তারা নিশ্চিতভাবেই এই সম্ভাব্য বরকত থেকে মাহরুম হবে। এখন সকালে না ঘুমিয়ে কাজ করলে কীভাবে বরকত আসবে তার ব্যাখ্যা করছি।
যারা সকালে দুই থেকে তিন ঘন্টা ঘুমান তারা না ঘুমিয়ে ঐ সময়টাতে কাজ করলে নিন্মুক্ত কাজগুলো করতে পারেন।
১. খুব ভোরে উঠে ফ্রেশ হয়ে কুরআন অধ্যয়ন এবং নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করতে পারেন। নামাজান্তে সারাদিনের কর্মপরিকল্পনা আল্লাহর দরগায় পেশ করতে পারেন। তিনি যেন সারাদিনের সব কাজে সাহায্য ও বরকত দান করেন সে দোয়া করতে পারেন। এতে আপনার অনেক কাজই সহজ হয়ে যাবে এবং অনেক বেশি কাজ করতে পারবেন।
২. ত্রিশ মিনিটের মত ব্যায়াম করে শরীরকে চাঙ্গা করে নিতে পারেন। এতে সারাদিনে যথেষ্ট কর্ম স্পৃহা পাবেন এবং পূর্বের চেয়ে বেশী কাজ করার উদ্যোম পাবেন। আর কাজ বেশি করলে আয় বেশি হবে, এটাই লজিক।
৩. সকালে না ঘুমালে ঘুমন্তদের চেয়ে অন্তত দুই ঘন্টা বেশি পড়ালেখা করা যায় যা স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে।
৪. এ সময়ে বাসায় কাজের লোক রাখলে সে যে কাজগুলো করতো সেই সে কাজগুলো আপনি নিজে করতে পারেন। যেমন, বাচ্চা ও নিজেদের কাপড়চোপড় কাঁচা, ঘর ঝাড়ু দেয়া এবং থালাবাসন পরিস্কার। এ কাজগুলোর জন্য কাজের বুয়াকে যে ৪/৫ হাজার টাকা দিয়ে থাকেন তা বেঁচে যাবে। তার মানে মাসে আপনার পাঁচ হাজার টাকা আয় বেড়ে গেল।
৫. বাসা বাড়ির আঙ্গিনায় বা ছাদে সবজি চাষ করতে পারেন। প্রতি সকালে সবজি খেত পরিচর্যার মাধ্যমে যদি কয়েক প্রকার সবজি আপনি উৎপাদন করতে পারেন তবে হিসেব কষতে বসে যান। সবজি না কিনতে হলে এ খাত থেকেও আপনার এক দেড় হাজার টাকা সেভ হবে।
৬. না ঘুমিয়ে সকালে রাস্তায় বের হলে আশপাশে কোথায় কী পাওয়া যায় তার খবরাখবর পাওয়া যায়। যেমন ধরুন- কোথায় ডেইরি ফার্ম আছে ফ্রেশ দুধ পাওয়া যায়, সবজি ও মাছের আরৎ কাছাকাছি থাকলে সেখান থেকে সস্তায় সবজি মাছ কেনা যায় ইত্যাদি। এতে কমদামে আপনি মানসম্মত জিনিস ক্রয় করতে ও খেতে পারেন। নিশ্চয়ই টাকাও কিছু বাঁচবে।
৭. বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বসতে পারেন। সাধ্যমত তাদের এক/দুইটা সাবজেক্ট দেখিয়ে দিতে পরলে কম কিসে। বেঁচে যাবে দেড় দুই হাজার টাকা।
৮. আর্লি টু বেড এণ্ড আর্লি টু রাইজ এবং সকালের ব্যয়াম আপনাকে রোগমুক্ত সুস্থ শরীর উপহার দিতে পারে। ফলে অতিরিক্ত ঘুম ও অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে যেসমস্ত রোগ শরীরে বাসা বাঁধে তা থেকে আপনি বেঁচে যাবেন। চিকিৎসার হাজার হাজার টাকা বেঁচে যাবে।
যদি জীবন নিয়ে সিরিয়াস হন তবে আরো অনেক কিছুই সম্ভব। আর এভাবেই আমরা কুরআন হাদিসের বাণীকে বাস্তব জীবনে রুপ দিতে পারি এবং দরিদ্রতাকে স্বচ্ছলতা দিয়ে ঢেকে দিতে পারি। কারণ দারিদ্র্য একটি কঠিন সমস্যার নাম। যা মানুষকে অন্যের নিকট হাত পাততে বাধ্য করে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। সুদের সাথে জড়ায়। পেটের ক্ষুধা মানুষকে সম্ভ্রম হারানোর দিকে ঠেলে দেয়।
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র নয় বরং একমাত্র দীন ইসলামই পারে সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন করতে। ন্যায় ও ইনসাফের সে সোনালী সমাজ আমাদের হাতছানি দিয়ে যায়। Ahmad Yasin
Discussion about this post