মুফতী মাহমুদ হাসান: হিজরী সন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে বিরহ বেদনা নিয়ে মদিনা শরিফ গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা।
কিন্তু দুঃখজনক কথা হিজরী নববর্ষ একের পর এক আমাদের দুয়ারে হাজির হচ্ছে কিন্তু আমরা তার খবরই জানি না। আমরা বলতে পারি না কোন দিন আরবী নববর্ষ। অথচ মুসলিম হিসেবে এটা আমাদের জানা দরকার ছিল।
তাই আসুন জেনেনিই হিজরী নববর্ষ ইতিহাস-ঐতিহ্য-তাৎপর্য।
২১/২২ আগস্ট রোজ শুক্রবার /শনিবার হিজরী নববর্ষ।(চাঁদ উঠার উপর নির্ভরশীল)১৪৪১ হিজরী বিদায় নিয়ে হিজরী নববর্ষ ১৪৪২ এর আগমন ঘটবে। পহেলা মুহররমের মধ্যদিয়ে হিজরী নববর্ষ ১৪৪২ এর সূচনা হবে।
হিজরী সনের ইতিহাসঃ
হিজরী সন মুসলমানদের সন,এটি এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। এটি এমন একটি স্মারক, যার সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে বিরহ বেদনা নিয়ে মদিনা শরিফ গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা।৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল কোবায় পৌঁছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন মহানবী (সা.)। এ হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে আমাদের হিজরি সন।
ইবনে সমরকন্দি বলেন, ‘আবু মুসা আশআরি (রা.) ওমর (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেছেন যে আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সালের গোড়াপত্তন করেন’। ’ আল্লামা ইবনুল আছির (রহ.) আল কামিল ফিত্ তারিখের মধ্যে এটিকে প্রসিদ্ধতম ও বিশুদ্ধতম অভিমত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (সূত্র : প্রাগুক্ত ১/৮)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সভায় সাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সাল গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। আলী (রা.) হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তারা সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।(উমদাতুল ক্বারি : ১৭/৬৬)
বর্ষ গণনা হিজরত থেকে কেন?
বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কি? অথচ মহানবীর সাল্লাহু সাল্লাম এর নবুয়তপ্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সাল গণনা শুরু করা যেত। এ প্রশ্নের উত্তরে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এভাবে দিয়েছে।মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর জন্ম,নবুয়াত,হিজরত ও ওফাত-এ চারটার মাধ্যমে সাল গণনা করা যেত। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের সাল নিয়ে মতপার্থক্য আছেআর মূত্যূ শোকের স্মারক। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা আরম্ভ করা হয়।( ফাতহুল বারী ৭/২৬৮)
হিজরী সন বলে নাম রাখার কারণঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আল্লাহ তা’য়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতের কথা গুরুত্বের সাথে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরী সন বলা হয়।
হিজরী সন মহররম থেকে শুরু হবার কারন?
হ্যাঁ এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে মহানবীর হিজরত হয়েছে রবিউল আউয়াল মাসে।তাহলে হিজরী বর্ষ মহররম মাস থেকে কেন শুরু করা হয়? আউয়াল মাস থেকে শুরু হওয়ার কথা।
এ প্রশ্নের জবাবে আল্লামা ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন লিখেছেন
তারা হিজরত থেকেই সাল গণনা শুরু করেন।আর মহররম কে প্রথম মাস হিসেবে স্বীকৃতি দেন।কেননা তৎকালীন আরবে মহররমই প্রথম মাস হিসেবে পরিচিত ছিল।জনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে বিঘ্ন না হয়,সে জন্য এটাকে পরিবর্তন করা হয়নি।(বেদায়া নেহায়া 4/517)
আল্লামা ইবনে হাজার রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন
রবিউল আউয়াল কে বাদ দিয়ে মহররম থেকে সাল গণনা শুরু করা হয়েছে। কেননা হিজরতের সূচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে মহররম থেকে। আর আকাবার দ্বিতীয় শপথও হয়েছে মধ্য জিলহজে।এ ভগ্ন মাসের পর নতুন চাঁদ উদিত হয়েছে মহররম মাসে।তাই একে দিয়েই বছর গণনা শুরু করা হয়েছে। আমার জানা মতে এটি দীর্ঘতম অভিমত। (ফাতহুল বারী 7 /268)
আল্লামা শওকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মতে মাসগুলোর এই ধারাবাহিকতা আল্লাহ প্রদত্ত। (তাফসীরে বগভী 2/345 সুরা তাওবা 36)
হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় হিজরী সনের প্রভাব সর্বাধিক। কেননা হিজরী তারিখ এর উপর ভিত্তি করেই সম্পাদিত হয় ইসলামের অনেক মৌলিক ইবাদত। যেমন হিজরী সনের প্রথম মাস মুহররম এ মাসের ১০ তারিখে পবিত্র আশুরা, তৃতীয় মাস রবিউল আউয়ালে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালামের জন্ম,ওয়াফাত ও হিজরত হয়েছে,ষষ্ঠ মাস রজবে মেরাজের মত মহান অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।সপ্তম মাস শাবান এই মাসের ১৫ তারিখে রয়েছে মহিমান্বিত শবে বরাত। নবম মাস সিয়াম সাধনার মাস রমজান। এ মাসের ৩০ দিন রোজা রাখা প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ এবং এ মাসেই রয়েছে পবিত্র ও মহান রজনী শবে কদর।দশম মাস শাওয়ালের প্রথম তারিখে পবিত্র ঈদুল ফিতর। দ্বাদশ মাস তথা শেষ মাস জিলহাজ,এ মাসে ৮ তারিখ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে পবিত্র হজ এবং ১০ তারিখে পবিত্র ঈদুল আজহা তথা কুরবানীর ঈদ।
বিশিষ্ট তাফসীরকারক ইমাম রাজী রহমাতুল্লাহ আলাইহি তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে কাবীরে লিখেন, মুসলমানরা তাদের যাবতীয় কাজ করবে হিজরী সন দিয়ে।(তাফসীরে কাবীর ১৬/৫৩)
মহান আল্লাহতালা রব্বুল আলামীনের নিকট চন্দ্র মাসের হিসাবই গ্রহনযোগ্য। যদিও বর্ষ মাস ইত্যাদির হিসাব সূর্যের আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতি দ্বারাও নির্ণয় করা যায়।কিন্তু চন্দ্রের ক্ষেত্রে কোরআন যে ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরীয়তে চন্দ্র মাসের হিসাব নির্ধারিত।
তাই আমাদের এ মাসের ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত হয়ে তা অনুকরণীয় চেষ্টা করি।
হিজরী বর্ষ অনুসরণে ইসলামী শরিয়তের বিধান কি?
হিজরী সন মুসলমানদের সন। মুসলমানদের উচিত এর অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে উদাসীনতা কাম্য নয়।ইসলামী ফিকাহবিদগণ চান্দ্রবর্ষের হিসাব রাখাকে মুসলমানদের জন্য ফরজে কিফায়া বলেছেন।অর্থাৎ কেউ কেউ এর খবরা-খবর রাখলে সবার দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে।কিন্তু সবাই যদি এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায় তাহলে প্রত্যেকে গুনাহগার হবে।এতে সন্দেহের অবকাশ নেই, চান্দ্রমাসের হিসাবের অনুসরণ নবীজি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত। যাদের অনুসরণ আমাদের জন্য পুণ্যময় ও কল্যাণকর আমল।
হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, সৌর হিসাব রাখা ও ব্যবহার করা একেবারেই নাজায়েজ নয়। বরং এই এখতিয়ার থাকবে, কোনো ব্যক্তি নামাজ, রোজা, জাকাত, ইদ্দতের ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষের হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে সৌর হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু শর্ত হলো, সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের মধ্যে চান্দ্র হিসাবের প্রচলন থাকতে হবে। যাতে রমজান, হজ ইত্যাদি ইবাদতের হিসাব জানা থাকে। এমন যাতে না হয়, শুধু জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য কোনো মাসই তার জানা নেই।
হিজরী নববর্ষের মুসলমানদের করণীয়:
হিজরী নববর্ষের মুসলমানরা কোন আনন্দ উৎসব করবে না,তবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহকর্মীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা গ্রহণ করবে। হিজরি নববর্ষে মুসলমানদের নব উদ্যমে উদ্দমী হতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।আমীন।
মুফতী মাহমুদ হাসান।
*আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(অনার্স) ঢাকা।
*দারুল ইফতা (ইসলামিক আইন ও গবেষণা বিভাগ) ঢাকা।
Discussion about this post