এনামুল হক, সিলেট : কখনো তিনি নায়ক , কখনো খলনায়ক। একের পর এক আলোচনার জন্ম দিয়ে সব সময় সংবাদের শিরোনাম হন তিনি। সেটা তার পক্ষে হোক আর বিপক্ষেই হোক সংবাদের শিরোনাম তিনি হবেনই।
পেঁয়াজের কেজি তিন শ টাকা। টিসিবির লাইনে সাধারণ মানুষের সাথে দাঁড়ালেন তিনি। হলেন সংবাদের শিরোনাম। কেউ বললেন ভেলকি কেউ বললেন নাটক কেউ বললেন এটাই রাজনীতি। কিন্তু যা হবার তো হয়ে গেছে।
এইতো ক’দিন হলো সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ কাউন্সিলর তার বিরুদ্ধে অনাস্থা পাঠালেন খোদ মন্ত্রনালয়ে। বিষয়টি নিয়ে নগর জুড়ে শুরু হলো তোলপাড়। বিরোধী পক্ষ বড় আটঘাট বেঁধে নামলেন মাঠে। এইতো মেয়রকে বরখাস্ত করার সুযোগ।
কিন্তু ডিফেন্সের পাকা খেলোয়াড় আরিফ সময় নেননি। গোল হতে যাওয়া বল নিজ কৌশলে পাঠিয়ে দেন ওপর প্রান্তের গোল পোষ্টে। বরাবরের মতো হতাশ হতে হয় প্রতিপক্ষকে।
করোনা কালের প্রথম দিকে অনেকটাই নিরব ভূমিকা পালন করেন তিনি। চারদিকে যখন আলোচনা সমালোচনার ঝড় তখন বিশাল ফুড ব্যাংক কার্যক্রম নিই হাজির হয়ে আবারও আলোচনার জন্ম দেন। সেই আলোচনায় ঘি ঢাললেন এক কাউন্সিলর। চিরচেনা রুপে স্ব গৌরবে লুটে নেওয়া চাল উদ্ধার করলেন মেয়র আরিফ।
গতকাল দিনভর ও সারা রাত নগর জুড়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন তিনি। ত্রাণ বিতরনে নয় জন মহিলা কাউন্সিলরকে জড়িত না করায় মেয়রের বিরুদ্ধে অবস্থান ধর্মঘটে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষনা করেন মহিলা কাউন্সিলররা। কিন্তু রাত পোহাতে না পোহাতেই একজন মহিলা কাউন্সিলরকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। মোড় ঘুরে যায় মেয়রের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচির।
হাসপাতালে অসুস্থ কাউন্সিলর সাকীকে দেখতেও যান মেয়র। শুক্রবার কাউন্সিলরদের সাথে আলোচনায় সম্মান জনক সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।
গত মেয়াদে মেয়র থাকাকালে উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের এমডিকে নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসেন মেয়র আরিফ। আর নগরের হকারদের কাছে তিনি এক মূর্তিমান আতংকের নাম আরিফুল হক চৌধুরী। হকারদের কাছে ফাটা কেষ্ট নামেই পরিচিত তিনি।
“অউ আইচ্ছে” বললেই আর রেহাই নেই হকারদের। বুঝতে বাকি থাকেনা যে মেয়র অভিযানে আসছেন। শুরু হয় ভো দৌড়……।
কিছুদিন আগে নগরীর চৌহাট্টায় লাইটেস স্ট্যান্ডের পরিবহণ শ্রমিককে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি
এভাবেই তিনি একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন তিনি।
শুধু তাই নয় । বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার হয়েও তিনি পুলিশ প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করতেন । আর নগর উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে “ছায়া মেয়র” হয়ে উঠেছিলেন অঘোষিত ভাবেই। সময়টা ২০০১ থেকে ২০০৬ চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে কথা ।
সরকারের প্রভাবশালী অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উন্নয়ন মহাযজ্ঞের মূল কারিগর হয়ে উঠলেন তিনি। সিলেটের প্রতিটি বিগ প্রজেক্ট বাস্তবায়নে তার হাতের ছোঁয়া ছিল বাধ্যতামূলক । শুনা যায় কোন কোন মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক কিংবা একনেকের বৈঠকেও এম সাইফুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে যেতেন। যা অন্য কারো বেলায় ছিল কল্পনাতীত।
সেই থেকে শুরু । আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । কিন্তু বিধি বাম হয়ে উঠে ওয়ান ইলেভেন নামক ভয়ংকর থাবা। দেশের শীর্ষ পঞ্চাশ দূর্নীতিবাজদের তালিকায় নাম চলে আসে তার । তিনিই আলোচিত সমালোচিত আরিফুল হক চৌধুরী।
জেল খেটেছেন, ওয়ান ইলেভেন এর কঠিন নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। তবে একটি জায়গায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । শুনা যায় এম সাইফুর রহমান সম্পর্কে তাকে মিডিয়ায় নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল এবং সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার বাদী হওয়ার কথা বলা হয়েছিল । কিন্তু “গুরু”র বিরুদ্ধে মামলা দূরের কথা জীবন বিপন্ন হলেও কোন কথা বলতে অস্বীকৃতী জানান তিনি।
সময়ের পট পরিবর্তনে 2013 সালের পনেরো ই জুনের সিটি নির্বাচনে বিশ দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন, পাঁচ ই মে শাপলা চত্বরের তান্ডব, আলেম উলামাদের উপর সরকারের দমন পীড়ন সহ নানা ঘটনায় বিরক্ত বিমর্ষ নগরবাসী টেলিভিশন প্রতীকে ভোট দিয়ে তার হাতে নগর ভবনের চাবি হাতে তুলে দেয়। উন্নয়নের অভিজ্ঞতার ভান্ডার নিয়ে শুরু ও হয়েছিল সুন্দর পথচলা। কিন্তু আরেক সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারই তার ঠিকানা হয়ে উঠে।
প্রায় 22 মাস পর কারামুক্ত হয়ে আবারও নগরীর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে শুরু করেন উন্নয়ন কাজ। তার উন্নয়নমুলক কাজে নগরবাসী যেমন খুশি ঠিক তেমনি তার নেতিবাচক বিতর্কিত কাজে ক্ষুদ্ধ অনেকেই ।
অভিযোগেরও শেষ নেই এই নগর পিতার বিরুদ্ধে । প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে তার পরিষদের তিন জন প্যনেল মেয়র হন তিন জনই তার দলের নেতা। কিন্তু দীর্ঘদিন হাসপাতালে জেলে বিদেশে থাকলেও একটি দিনের জন্য ও কোন প্যনেল মেয়রকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র এর স্বাদ নিতে তিনি বাঁধার পাহাড় তৈরি করেন। এ নিয়ে কোর্ট চালিচালিও কম হয়নি । যা শান্তি প্রিয় নগরবাসী ভাল চোখে দেখেননি।
দল এবং জোটের নেতাকর্মীরা যখন হামলা মালা গুলি মিছিল সমাবেশ বাসা বাড়িতে পুলিশি অভিযানে দিশেহারা, তখন তিনি নিজের গা বাঁচাতে সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলের সাথে আতাত করে চলেছেন বলে অভিযোগ শুনা যায় । তিনি জোটের শরীক দল দূরের কথা তার নিজ দল বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে যে দেওয়াল তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ দলীয় কর্মীদের।
জোটের নেতাদের অবমূল্যায়ন ও এড়িয়ে চলার নীতি অনেকেই বিরক্ত মনোভাব দেখিয়েছেন । “হাঠাও শিবির বাচাও ছাত্রদল” ব্যানারে একটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে বেশ বিতর্কিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সব কিছুর পরও শেষ বেলার দক্ষ খেলোয়াড় “মিষ্টার ফিনিশার” খ্যাত মেয়র আরিফ এগিয়ে চলেছেন। শেষ মুহূর্তে কিভাবে ফিনিশিং দিতে হয় গত দুটি নির্বাচনে নিজ দলের মনোনয়ন দৌড়ে টিকে থেকে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।
আলোচনা সমালোচনা যাই থাকুক তা যেন হয় নগরের উন্নয়নের স্বার্থে। উন্নয়ন হোক সমৃদ্ধির সোপান।
লেখক- সাংবাদিক, কলামিষ্ট,
০৮-০৫-২০২০
Discussion about this post