সবজি উৎপাদনের এলাকা বলে খ্যাত রংপুর অঞ্চলে করোনার প্রভাবে সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ায় কাঁচা তরিতরকারি ও সবজি বাজারে ধস নেমেছে। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাওয়া তো দূরের কথা পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের উৎপাদিত পণ্য। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে করোনার প্রভাবে দিশেহারা অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে নিজের উৎপাদিত ২২ মণ সবজি দিয়েছেন রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়া গ্রামের কৃষক বিপ্লব কুমার। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সমাজের অনেক মানুষ ঠিক মতো খেতে পারছে না। সেই তুলনায় আমার পরিবার অনেক ভালো আছে। অসহায় দুস্থ মানুষদের কথা চিন্তা করে আমি ক্ষেতের সবজি ‘উই ফর দেম’ নামের একটি সংগঠনকে দিয়েছি। তারা ত্রাণ সামগ্রীর সাথে এসব সবজি বিতরণ করবে।
রংপুরের বৃহৎ কাঁচা তরিতরকারির আড়ৎ সিটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পানির দামে বিক্রি হচ্ছে সবজিসহ কাঁচা তরিতরকারি। একমাত্র আদা ১২০ টাকা কেজি ছাড়া অন্যসব তরিতরকারির দাম খুবই কম। ব্যবসায়ীরা জানান, শসা ২০ টাকা কেজি, করলা ২৫ টাকা, গাজর ১৫ টাকা, ভেন্ডি ৩০ টাকা, বরবটি ২০ টাকা, রসুন ৬০ টাকা, ফুলকপি বড় সাইজ ১০ থেকে ১৫ টাকা, বাঁধাকপি ১০ টাকা, পটল ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল নিয়ে অলস সময় পার করছেন, খদ্দের নাই বললেই চলে। এছাড়া গ্রামের হাট-বাজারে কাঁচা তরিতরকারির দমি আরও কম। দেশিয় পিঁয়াজ ৩০ টাকা কেজি, কাঁচামরিচ ১৫ টাকা কেজি, টমেটো ১০ টাকা, বেগুন ৫ টাকা কেজিতে নেমে এসেছে। তার পরেও খদ্দের মিলছে না বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বুড়িরহাটের তরিতরকারি ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া বলেন, এবারের মতো এতো কম দাম গত ২০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে কখনও দেখিনি। প্রতিদিনই লোকসান গুণতে হচ্ছে। কারণ এসব পণ্য তো দুই দিনের বেশি রাখা যায় না। তাছাড়া অর্থ সংকটে খদ্দেররা প্রয়োজনের অর্ধেক কিনছে। সাহেব আলী নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষ বাজারে আসছে ঠিকই। কিন্তু কমদামে সবজি কেনারও সামর্থ্য তাদের নেই। তিনি বলেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।
সবজি উৎপাদিত এলাকাগুলোতে কৃষকদের অবস্থা আরো করুণ। রংপুরের বলদীপুকুর, দমদমা, জায়গীরহাট, রানীপুকুরের মতো বড়বড় সবজি ও তরিতরকারির পাইকারি হাটে ঘুরে দেখা যায়, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন তরিতরকারির স্তুপ পড়ে থাকলেও খদ্দের নেই। ফলে এসব সবজি রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। জায়গীরহাটের সবজি চাষি ভোলানাথ ও আলম মিয়া বলেন, আমরা মূলত সবজি চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। এবার আমাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। পানির দামেও নেবার কেউ নেই। এমনি সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যাবসায়ীরা সবজিসহ কাঁচা তরিতরকারি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যেত কিন্তু এবার তারা কেউই আসছেন না। ফলে পানির দামে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
এদিকে একঝাঁক উদ্যমী তরুণ করোনা ক্রান্তিতে দিনে-রাতে সমানে লড়ছে। কখনো খাবার হাতে, কখনো বা ওষুধ নিয়ে। নতুবা হ্যান্ড মাইক আর রঙ-তুলি নিয়ে ছুটছে ওরা। থেমে নেই ওদের করোনা যুদ্ধ। ওরা সবাই ‘উই ফর দেম’ এর স্বেচ্ছাসেবী। করোনার প্রভাবে দিশেহারা অসহায় মানুষের জন্য স্বেচ্ছায় কাজ করছে ওরা। ওদেরকে উৎসাহিত করতে অনেকেই বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহায়তার হাত। এবার ‘উই ফর দেম’ টিমকে বিনামুল্যে ক্ষেতের ২২ মণ সবজি দিয়েছেন রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়ার কৃষক বিপ্লব কুমার। এর মধ্যে রয়েছে আট মণ মিষ্টি কুমড়া এবং ১৪ মণ বেগুন। বিপ্লব কুমার বলেন, ‘এমনিতে সবজির দাম নেই, এই সময়ে ঘরে থাকা অসহায়দের দিতে পারলেও কাজে লাগবে।’
উই ফর দেম এর প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ বলেন, আমাদের একটু কষ্টে যদি কয়েকজন মানুষের পেট ভরে তাতে মন্দ হয় না। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। কৃষক বিপ্লব কুমারের দেওয়া ২২ মণ সবজি অসহায় মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হবে জানিয়ে তিনি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে আসা পর্যন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা চান।
Discussion about this post