কুয়েতে মানব ও অর্থ পাচার সঙ্গে হাজার কোটি টাকার কারবারের অভিযোগ ওঠেছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে । দেশটিতে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের মুখে বাংলাদেশের এই সংসদ সদস্য কুয়েত ছেড়ে পালিয়েছেন বলে কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের পত্রিকাগুলো খবরে বলা হয়েছে।
শহিদুল ইসলাম মূলতঃ কুয়েতপ্রবাসি বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শহিদ আওয়ামী লীগের আওয়ামী ঘরণার প্রবাসী হিসেবে শহিদ মনোয়ন আওয়ামী লীগ থেকে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহাজোটের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ নোমানকে নির্বাচনে এই আসন থেকে সমর্থন দেওয়া হলে শহিদ সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আপেল প্রতীকে নির্বাচন করেন। তবে মাঝ পথে এসে নির্বাচন থেকে সরে মোহাম্মদ নোমান দাঁড়ালে স্বতন্ত্রপ্রার্থী মোহাম্মদ শহিদ ইসলামকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয়।
পরবর্তীতে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন-৪৯ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বুধবার কুয়েতের শীর্ষ সংবাদ মাধ্যম আল কাবাস জানায়, কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে পরিচালিত অভিযানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একজন বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। অর্থ ও মানব পাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তি একটি অসাধু চক্রের সদস্য যার মূল হোতা বাংলাদেশি সংসদ সদস্য। তাদের সঙ্গে আরও একজন জড়িত আছে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সাংসদ বিপদ আঁচ করতে পেরে এক সপ্তাহ আগে দেশ ত্যাগ করে। যখনই তিনি বুঝতে পারেন সিআইডির কর্মকর্তারা তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তৎপর হবে তখনই তিনি পালিয় চলে আসেন। বিপদ বুঝে তার অপর সঙ্গীও কুয়েত ছাড়া হয়েছেন। পলাতক এই সাংসদের সংস্থার মানবসম্পদ রফতানি সম্পর্কিত যেসব নথিপত্র ছিল সেগুলো বাতিল করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আল কাবাসের তথ্যমতে, অভিযুক্তরা তিনটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে। তারা ২০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে কাজ দেয়ার কথা বলে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। ধারণা করা হচ্ছে এই অর্থের পরিমাণ ৫০ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার। অবাক করা তথ্য হল, এই তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন বাংলাদেশে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি দেশের একটি বৃহৎ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আছেন যেটির সুবিধা আদায় করে তিনি বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে অর্থ পাচার করেছেন।
যেসব শ্রমিকদের আনা হয়েছে তারা সবাই ভিসা জালিয়াতির শিকার। তাদেরকে যেই বেতনের চুক্তিতে আনা হয়েছিল সেই বেতন থেকে তাদের অনেক কম বেতনে খাটানো হত।
সূত্রের মতে, সিআইডি-র কর্তারা তদন্তের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন ওই তিন জনের চক্রটি বাংলাদেশে একটি বড় জালিয়াতি নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্কিত। এই নেটওয়ার্কটি ভিসা জালিয়াতির সাথে জড়িত যারা শ্রমিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৮০০ থেকে ২২০ দিনার পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে যেখানে চালকদের চাকরি দেয়ার ভিসার জন্য আদায় করা হয়েছে জনপ্রতি ২৫০০ থেকে ৩০০০ দিনার।
বৃহস্পতিবার মানবপাচার নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে আল-কাবাস জানিয়েছে, বাংলাদেশি ওই সংসদ সদস্য সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েতে একজন মার্কিন বাসিন্দার সঙ্গে আর্থিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন। কুয়েতে আয় করা বেশিরভাগ অর্থই তিনি আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সূত্রের বরাতে আল কাবাসের খবরে জানানো হয়- প্রাথমিক পর্যায়ে কুয়েতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে নিজেই প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশীদার হয়ে ওঠেন। এরপর আর তার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে শুরু করেন।
ওই সংসদ সদস্য কুয়েতে এমন বেশকিছু টেন্ডার কেনেন, যেগুলো লাভজনক ছিল না। সেগুলো কেনার উদ্দেশ্য ছিল, চুক্তিগুলোর আওতায় কুয়েতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নেয়া। এসব কর্মী নেয়ার মাধ্যমে আয় করা অর্থ দিয়েই ওই টেন্ডারগুলোর অর্থায়ন করতেন তিনি। অবৈধভাবে আয় করতেন ব্যাপক অর্থ।
বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার জন্য কুয়েতে তার প্রতিষ্ঠানটি যেন সরকারি চুক্তি পায় সেজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্থ কয়েকজন কর্মচারীর কাছে অডিও এবং ভিডিও প্রমাণ আছে যে, সংস্থার কর্মীদের তাদের ভিসা অন্য সংস্থায় স্থানান্তর করতে দেওয়ার পরিবর্তে আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। সিআইডি গোয়েন্দারা এইসব কর্মীএবং সংস্থার কিছু কর্মকর্তাকে তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানা গেছে।
আল কাবাসের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, তিন আসামির মধ্যে একজনকে (সুলতান) বলা হয় যদিও তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন, তবে তিনি এখনও বড় কোম্পানির কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্কে বজায় রেখেছেন এবং তিনি সক্রিয় রয়েছেন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে শ্রমিক আনা এবং কুয়েতের বাইরে যাংক একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করাতে। সাংসদ ছাড়াও এই ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনের আরো একজনের পরিচয় কেবল এস (S) বলে জানা গেছে যে বর্তমানে ইউরোপের একটি দেশে অবস্থান করছে।
কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশি সংসদ সদস্য নিয়ে কুয়েতের পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের সূত্র ধরে সিআইডির যোগাযোগ করে দূতাবাস কর্র্তপক্ষ। সিআইডি থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে মারাতিয়া কুয়েতি গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর স্বত্বাধিকারী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ।
দূতাবাসের দায়িত্বশীল সূত্র আরও জানিয়েছে, সাংসদ পাপুল কুয়েতে নেই এটাও নিশ্চিত করেছে সিআইডি। তবে কুয়েতি সংবাদ মাধ্যমে একজন গ্রেপ্তারের যে খবর বেরিয়েছে তার পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
অভিযােগের বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য এবং কুয়েতপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের সঙ্গে জন্য যেগােযােগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে আকাশযাত্রা। তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি এবং তিনি এ মুহুর্তে কোথায় আছেন সে ব্যাপারেও নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে আকাশযাত্রার যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যদি পাওয়া যায় এই বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরা হবে। বিস্তারিত জানতে সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে দূতাবাস।
সূত্র : আল কাবাস ও আরব টাইমস
Discussion about this post