সদ্য প্রকাশিত প্রথম পর্বের রাজাকারের তালিকা সংশোধন হতে যাচ্ছে। তবে নাম নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেলেই এটি প্রত্যাহারের পর সংশোধনের মাধ্যমে ফের প্রকাশ করা হবে। ‘দুই-একশ’ নামে ভুল হলে সেগুলো সংশোধন করে দেয়া হবে। এ ভুলের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে- মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কীভাবে এ তালিকায় এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করে তালিকা থেকে তা বাদ দেয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার নিজ দফতরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের এ তালিকায় সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম আসায় আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। তিনি বলেন, ভুলের পরিমাণ এক-দুই শতাংশ হলে এক ধরনের ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত রাজাকারদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকা আগেই তৈরি করে রেখে গেছে। সেখানে কোনো ইল মোটিভ থাকতে পারে, উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। যেভাবে আছে, সেভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এটা এডিট করি নাই, দাঁড়ি-কমা, সেমিকোলন চেঞ্জ করি নাই।
মন্ত্রী বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া ওই তালিকা আমি পড়েও দেখি নাই। জাতির দাবি ছিল, তাই আমরা শুধু প্রকাশ করেছি। এতে গেজেটভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম আসায় বলা হচ্ছে ভুল-ত্রুটি রয়েছে। আমরা সেটা স্বীকারও করি। যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম এ তালিকায় এসেছে তাদের মনঃকষ্টও আমি অনুভব করছি। তাদের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোথায় পেল? তারা কি বানিয়ে লিখেছে?
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নোট ছাড়াই রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়, তাতে নোট দেয়া ছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়- এত নম্বর থেকে এত নম্বরের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ওই নোট ছাড়াই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশা করেন, নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই শেষে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এদিকে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা। তারা তালিকাটি দ্রুত সংশোধনের দাবি জানান। একই সঙ্গে এই ভুলভ্রান্তির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এর আগে রোববার ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের এ তালিকায় সরকারি গেজেটভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢোকায় তা নিয়ে দেশব্যাপী চলছে ধুন্ধুমার। এ নিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তবে ওই ভুলের জন্য তার মন্ত্রণালয়ের দায় অস্বীকার করেছেন তিনি। পরিস্থিতি সামাল দিতে মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিন গণমাধ্যমে ‘রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর ব্যাখ্যা’
শিরোনামে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা সুফি আবদুল্লাহিল মারুফের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন।
বরং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা। এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কীভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই অন্তে তাঁর/তাঁদের নাম এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। এই প্রকাশিত তালিকায় অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নাম এসেছে নবম সেক্টরে মেজর আবদুল জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তীর। তপন কুমার চক্রবর্তীর বাবা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।
শহীদ সুধীর কুমারের স্ত্রীকেও ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের’ তালিকায় রাখা হয়েছে। সরকারি গেজেটভুক্ত, নিয়মিত সম্মানী পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিজয়ের মাসে ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান’ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বাসদ নেতা ডা. মনীষা চক্রবর্তী।
একইভাবে রাজশাহীর রাজাকারের তালিকায় এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর নাম। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মজিবুল হক, বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত আইনজীবী মহসিন আলী, আবদুস সালাম, তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ, পুলিশ কর্মকর্তা এসএস আবু তালেব, জয়পুরহাট মহকুমার (সাব-ডিভিশন) সাবেক গভর্নর কছিম উদ্দীন আহম্মেদ, সাবেক জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) মজিবর রহমান আক্কেলপুরী, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ফরেজ উদ্দীন মাস্টার, প্রয়াত মজিবর রহমান মাস্টার, প্রয়াত তাহের উদ্দীন মাস্টার, প্রয়াত ডা. মহসিন আলী মল্লিক, প্রয়াত হবিবর রহমান, প্রয়াত নজিবর রহমান সরদার, মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলামসহ আরও অনেকের নাম এসেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায়। যারা জাতীয় বা স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত।
অনেকে আবার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্টদের পরিবার, স্বজনরা ও সাধারণ মানুষ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, এখনও এ তালিকা সংশোধন করা সম্ভব। কে করতে পারে সঠিকভাবে? ওই সময়কার লোকেরা। তাই তাদের জীবিত অবস্থায় প্রকাশ পাওয়ায় আমি মনে করি, তারা আহত হলেও, কষ্ট পেলেও একটা সংশোধন হওয়ার সুযোগ হয়েছে।
যদি এটা ৩০ বছর পর প্রকাশ হতো, তাহলে সংশোধন হওয়ার সুযোগ থাকত না। এ ভুলের জন্য জাতির কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন। ক্ষমা চাইবেন কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, দুঃখ প্রকাশ করার অর্থ যদি আপনি না বোঝেন তাহলে আর কি?
আমি কী এটা করেছি? এটা যদি আপনি চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে এসে দেখে যান রেকর্ড। আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে যেটা বলছি, সেখানেই থাকেন। তালিকা আমরা তৈরি করি নাই। জাতির দাবি ছিল, তাই প্রকাশ করেছি। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করি নাই। দুঃখ প্রকাশ করা আর ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে ‘কোনো পার্থক্য নাই’ মন্তব্য করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, আমি এ কাজ না করেও দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।
তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বাসদ নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, আমার নাম এলে আমি যেভাবে কষ্ট পেতাম, উনারাও সেভাবে কষ্ট পেয়েছেন। সে জন্য আমি ব্যথিত। আমিও কষ্ট পেয়েছি, সেটা তো আমি বলেছি। সংশোধনের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজাকারের তালিকার বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকলে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে।
তার বিষয়ে তদন্ত করে তথ্য-প্রমাণসাপেক্ষে সংশোধন করা হবে। আমরা যেহেতু তালিকা প্রকাশ করেছি তাই এর সংশোধনের দায়িত্বও আমরা নিলাম।
গত রোববার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে সেই সব স্বাধীনতাবিরোধীর মধ্যে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের প্রথম তালিকা প্রকাশ করা হল। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তালিকা দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে।
Discussion about this post