আধুনিক বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি আল মাহমুদের ৮৪তম জন্মদিন আজ ১১ জুলাই (বৃহস্পতিবার)। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আল মাহমুদের পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাট দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।
কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলী’। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরও দুটি কবিতার বই ‘কালের কলস ও ‘সোনালী কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালী কাবিন’ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠ’ তার উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপা হওয়ার কারণে ফেরারী হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকার স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। নিজের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা রচনা করে গেছেন কালজয়ী দুটি উপন্যাস কাবিলের বোন ও উপমহাদেশ।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আল মাহমুদ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ সম্মাননা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির কারণে আল মাহমুদ জীবনব্যাপী মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন কোনো স্বীকৃতিই তার সঙ্গে তুল্য নয়।
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বব্যাপ্ত এ কীর্তিমান নিজের অমরতা নিশ্চিত করে লোক থেকে লোকান্তরিত হন চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারী। লোক-লোকান্তরের কবি আল মাহমুদের লোকান্তরিত হওয়ার ১৪৫তম দিনে কবির জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছে তার ভক্তকুল। কিংবদন্তী এ কবির জন্মদিন উদযাপনে ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে মরোনোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারি প্রদানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেবার দাবী জানিয়েছেন কবি পরিবার।
Discussion about this post