আমার ভাইডা আর আমার ছওয়ালডার (ছেলে) একসাথে ইতালি যাইবার স্বপ্ন ছিল। সেই দিনকা রাইতেও কথা হইছিল। ওরা দুজনই কইল, ভালো আছে, কোনো সমস্যা নাই। দালালে নাকি ওগের খুব তারাতারি গেম দিব। এই কি সেই গেম! আমার ছওয়ালও নাই, ভাইও নাই। হায় আল্লাহ, আমার লগে এইডা কী হইল। তুমি খোদা, আমার বুকের ধনডারে ফিরাইয়া দাও।’
আহাজারি করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন গৃহিণী কুলসুম বেগম। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা।
সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মাদারীপুরের রাজৈর পৌরসভার পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকায় তাদের বাড়িতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়।
ভূমধ্যসাগরে নৌযান ডুবে লিবিয়া উপকূলে ভেসে আসা ২৩টি মরদেহের মধ্যে ২টি কুলসুমের ভাই আবুল বাসার আকন (৩২) ও ছেলে টিটু হাওলাদারের (১৯) বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা। আবুল বাসার উপজেলার গোবিন্দপুর এলাকার আক্কাস আলী আকনের ছেলে। তার ভাগনে টিটু হাওলাদার রাজৈর পৌরসভার পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকার চা বিক্রেতা হাসান হাওলাদারের ছেলে।
উল্লেখ্য, অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার অন্যতম একটি পথ লিবিয়া। এ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় ছোট ছোট নৌকা। এসব নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয়। প্রতিবছর এ পথে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী। এই যাত্রা ‘গেম’ নামে পরিচিত।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন একদল অভিবাসনপ্রত্যাশী। ৫৬ জন আরোহী নিয়ে নৌযানটি গত ২৫ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এরপর ২৮ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ২৩টি মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে। গলিত ওই মরদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রের বরাতে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি।
রাজৈরের মামা-ভাগনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আবুল বাসারের ভাই বাচ্চু আকন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাগনের মৃত্যুর সংবাদটি প্রথমে দালালের মাধ্যমে পাই। খবরটা পেয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়ি। পরে খবর আসে আমার ভাইও আর নেই। দুজনেরই একসঙ্গে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না। দালাল বলেছিল, কোনো সমস্যা ছাড়াই তারা ইতালি পৌঁছাবে। দালালকে এখন আর কোনোভাবেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ভাই আর ভাগনের লাশ কোথায় কী অবস্থায় আছে, তা–ও কেউ বলতে পারছে না।’
বাচ্চু আকন আরও জানান, আবুল বাসার ও টিটু হাওলাদার বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে পরিবারের কষ্ট ঘোচাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য দেড় বছর আগে ১৪ লাখ টাকা চুক্তিতে মহেন্দ্রদী এলাকার স্বপন দালালের মাধ্যমে কৃষি ভিসায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়। পরে স্বপন অপারগ হলে বাধ্য হয়ে লিবিয়া দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য মনির হোসেন নামের আরেক দালালের মাধ্যমে নতুন চুক্তি করে আবুল বাসার ও টিটুকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ১ জানুয়ারি ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন আবুল বাসার ও টিটু হাওলাদার। তাঁরা ঢাকা থেকে প্রথমে দুবাই হয়ে লিবিয়া পৌঁছান। পরে সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে পাঠানো হয় উপকূলীয় এলাকায়। ২৪ জানুয়ারি লিবিয়ার উপকূল থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রা করেন তাঁরা। কিন্তু ইতালি পৌঁছার আগেই নৌকাটি ডুবে যায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মামা-ভাগনে ছাড়াও রাজৈর উপজেলায় আরও ৮ জন নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের সবার বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে। তবে তারা ডুবে যাওয়া নৌকায় ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ভাস্কর সাহা বলেন, লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা বলে শুনেছেন। তারা তিনজনের নিহতের তথ্য পেয়েছেন। তবে বিস্তারিত নয়। এ ঘটনায় অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পুলিশ কাজ করছে। আর এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লিবিয়া হয়ে ইতালি নেওয়া দালাল চক্রের মূলহোতা রাজৈর হরিদাসদি গ্রামের স্বপন মাতুব্বর, মজুমদারকান্দি গ্রামের মনির হাওলাদার ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আলীপুরের রফিক। তারা ইউরোপে পাঠানোর চুক্তি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৮ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত হাতিয়ে নেন। লিবিয়ার পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বা ওই দেশের মাফিয়া সন্ত্রাসীদের হাতে আটক হলে গুনতে হয় আরও কয়েক গুণ টাকা।
এদিকে পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন স্থানীয় দালালরা। তাদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
নিহত টিটু হাওলদারের চাচাতো ভাই রেজাউল হাওলাদার বলেন, ‘দালালে লোভ দেখাইয়া আমার ভাইকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিবে, কখনোই তা ভাবতে পারি নাই। দালালের কঠিন বিচার চাই। আর আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহ্ মোহাম্মদ সজীব বলেন, নিহত ব্যক্তিদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দূতাবাসের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।
Discussion about this post