চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের আজগর আলী। এক সময়ের প্রাণবন্ত এই তরুণ ১৯৯৩ সালে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে জীবনের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পরিবারকে সুখে রাখার প্রত্যয়ে তার এই যাত্রা শুরু। কিন্তু তিন দশক পর আজ তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে আছেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত আজগর এখন একেবারেই একা। তার পাশে নেই তার প্রিয় কর্মস্থল, নেই মালিকপক্ষ।
এরপরে কোম্পানির মালিকানার পরিবর্তন হয়, নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘পাওয়ার ম্যাক ইলেকট্রো ম্যাকানিক্যাল সার্ভিসেস এলএলসি’। কিন্তু আজগর থেকে যান সেখানেই। মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং পরবর্তীতে তার ছেলে মোহাম্মদ সেলিম পারভেজ। এই দুই মালিকের অধীনে আজগর কাজ করে গেছেন দীর্ঘ ২৩ বছর।
২০২৪ সালের পুরো বছরে আজগর কোনো বেতন পাননি আজগর আলী। চার সন্তানের বাবা আজগরকে প্রতিনিয়ত পড়তে হয়েছে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধের শঙ্কায়। এই সময়ে বাড়ি থেকে আসা ফোনকলগুলোও তার জন্য হয়ে উঠেছিল একেকটা দুঃসস্বপ্ন।
বেতন নিয়ে মালিক মোহাম্মদ সেলিম পারভেজের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করেছিলেন আজগর। উত্তর ছিল প্রতিবারই এক রকম, ‘হবে, হয়ে যাবে।’ কিন্তু দিন পার হতে হতে সময় এমন একপর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে আজগরের লেবার কার্ডের মেয়াদ শেষ, ভিসাও নবায়ন করা হয়নি। ফলে অবৈধ শ্রমিক হয়ে পড়েন তিনি। যার কারণে প্রতিদিনের জরিমানা যোগ হতে থাকে তার নামে। ঘটনা এ পর্যন্ত হলেও ভালো হতো। অন্তত সাধারণ ক্ষমার সুযোগে ভিসা নবায়ন ও আইনি লড়াইয়ে কিছুটা হলেও অধিকার এবং বকেয়া আদায়ের সুযোগ পেতেন আজগর আলী। তবে পরিস্থিতি বদলে যায় ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখ রাতে। রাতের খাবার খেয়ে আজগর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য। তারপর আর ঘরে ফেরা হয়নি তার। মাথায় হাত দিয়ে হঠাৎ চেতনা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, তিনি গুরুতর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। পরের ৪৮ ঘণ্টায় তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয় তার মাথায়। পুরো মাথায় বিশেষ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করে আনা হয় ছড়িয়ে পড়া রক্ত। এরপর থেকে তাকে রাখা হয় আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু এরমধ্যেও তার জন্য কোনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি মালিকপক্ষ। কূলকিনারা না পেয়ে বিচারের আশায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, দুবাইয়ের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছে আজগর আলী বড় ভাই মোহাম্মদ আলী। আরব আমিরাতের লেবার কোর্টেও তিনি বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে আজগরের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, তারা একাধিকবার মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং মোহাম্মদ সেলিম পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত মালিকদের কাছে সাহায্যের জন্য গিয়েছে, কিন্তু উত্তর একটাই ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারব না’। কখনো বা উত্তর এসেছে, ‘আমরা তাকে সব হিসাব বুঝিয়ে দিয়েছি। তার সঙ্গে আর কোনো লেনদেন নেই।’ মালিকপক্ষের এমন উত্তরের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিভিন্ন সময় পাওনা অর্থ চাইলে আজগরের হাতে দেওয়া হতো ব্যাংক চেক। যা ব্যাংকে হস্তান্তর না করার শর্তে নামকাওয়াস্তে কিছু অর্থ দেওয়া হতো তাকে।
আজগরের পরিবার জানায়, গত প্রায় দুই যুগের চাকরি জীবনে আজগর একদিনের জন্যও তার প্রাপ্য ছুটি বা ভাতা সঠিক সময়ে এবং নিয়মমাফিক পাননি। মালিকপক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুত চেকগুলো পর্যন্ত বাউন্স করেছে। যার কারণে তাদের পড়তে হয়েছে চরম আর্থিক সংকটে। সন্তানদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ চরম হুমকিতে পড়েছে। অথচ আজগর আলী এক সময় ভাবতেন, তার শ্রমে-ঘামে যে কোম্পানি দাঁড়িয়েছে, তারা হয়তো তার কষ্টের মূল্য দেবে। কিন্তু এখন তিনি জানেন, তার জীবনের পরিশ্রমের বিনিময়ে পেয়েছেন শুধুই প্রতারণা।
আজগর এখন দুবাইয়ের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তার পরিবার দেশে অসহায়। তারা জানে না, আজগর যদি মারা যায়, তার দেহ দেশে ফেরানো যাবে কি না। তারা আশায় বুক বেঁধেছেন, কোম্পানির পক্ষ থেকে কেউ একজন এগিয়ে আসবে, আজগরের পাওনা বুঝিয়ে দেবে, তার চিকিৎসার খরচ দেবে। দিনশেষে আজগরের চার শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও কেউ উদ্যোগী হবেন।
Discussion about this post