‘আব্বু আমি আন্দোলনে আছি, এই মুহূর্তে আসতে পারব না। বিজয় নিয়েই বাসায় ফিরব। বাঁচলে বীর, মরলে শহীদ।’
এটাই ছিল বাবার সাথে তানজিল মাহমুদ সুজয়ের শেষ কথা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামের মো: শফিকুল ইসলামের একমাত্র ছেলে তানজিল মাহমুদ সুজয় (১৯)। গাজীপুর ভাওয়াল সরকারি বদরে আলম কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার অদূরে একটি ভাড়া বাসায় বাবার সাথে থাকতেন তানজিল। ছোট দুই বোন ইসরাত জাহান এনি আক্তার (১৮) ও ইসমাত জাহান সোহরিন আক্তারকে (১৪) নিয়ে মা তাহমিনা আক্তার (৪২) থাকতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বিটঘর গ্রামের বাড়িতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম থেকেই সরব ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী তানজিল মাহমুদ সুজয়। প্রতিদিনের মতোই গত ৫ আগস্ট খুব সকালেই যোগ দেন ছাত্র আন্দোলনে। দুপুরের পরে ফ্যাসিবাদি শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পরার পর সারাদেশ যখন বিজয় উৎসব পালন করছে, ঠিক সেই সময়ে বিকেলে উল্লসিত জনতার মিছিলে গুলি চালায় ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা পুলিশ। গুলিতে বাইপালে শহীদ হন তানজিল। পরে পুলিশ তার লাশ ভ্যান গাড়িতে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
শহীদ সুজয়ের পরিবার আরো জানায়, ঢাকা জেলার আশুলিয়া ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের ফ্যামিলি কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে গুলিবিদ্ধ তানজিলসহ ১১ জন শিক্ষার্থীর লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। পরে আশুলিয়া থানা পুলিশ সদস্যরা লাশগুলো একসাথে করে ভ্যানের ওপর স্তুপ করে রাখে। লাশগুলো থানায় পার্ক করা একটি পিকআপে তুলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। সে দিনের পৈশাচিকতার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
শহীদ তানজিলের আংশিক পুড়ে যাওয়া লাশ গত ৭ আগস্ট (বুধবার) সকাল ৯টায় নিজ বাড়ি নবীনগরের বিটঘর কবরস্থানে জানাযা শেষে দাফন করা হয়।
তানজিলের বাবা মো: শফিকুল ইসলাম (৫০) গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চান্দুর এলাকায় বেকারি ব্যবসা করতেন। এখন তিনি গ্রামের বাড়িতে এসে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, “সুজয় মিছিলে থাকা অবস্থায় আমার সাথে মোবাইলে ওর শেষ কথা হয়। বাসায় দ্রুত চলে আসার কথা বললে সুজয় বলে, ‘আব্বু আমি ছাত্র আন্দোলনে আছি, এই মুহূর্তে আসতে পারব না। বিজয় নিয়েই বাসায় ফিরব। বাঁচলে বীর, মরলে শহীদ।’ এরপর ৫ আগস্ট বেলা ৩টার পর ছেলেকে ফোনে না পেয়ে হাসপাতালসহ সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করি। ওইদিন তার কোনো সন্ধান পাইনি। পরদিন অগ্নিদগ্ধ আশুলিয়া থানার পিকআপ ভ্যানের লাশের স্তুপ থেকে আমি সুজয়কে শনাক্ত করি।”
একমাত্র ছেলে সন্তানের এমন মৃত্যুতে পাগলপ্রায় সুজনের মা। তিনি বলেন, কত স্বপ্ন ছিল, আমার তানজিল মাহমুদ সুজয় পরিবারের হাল ধরবে, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এমন হৃদয় বিদারক হত্যার সাথে জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি করেন তার স্বজনরা।
সুজয়ের ছোট বোন ইসরাত জাহান এনি আক্তার বলেন, ‘আশুলিয়া থানা পুলিশ শুধু আমার ভাইকে হত্যা করেনি, লাশ পুড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি বায়েজিদুর (সিয়াম) বলেন, ‘তানজিল মাহমুদ সুজয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। সুজয় আমাদের গর্ব। পাশাপাশি জুলাই গণঅভুত্থানে তার ভূমিকাটি অপরিহার্য ছিল।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলার ২০ জন নিহতের একটি খসড়া তালিকা আমরা পেয়েছিলাম। পরে যাচাই-বাছাই করা হয়। এর মধ্যে তালিকায় ১৩ নম্বরে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের তানজিল মাহমুদ সুজয়। তার নামটি শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সুপারিশসহ গৃহীত হয়েছে।’
Discussion about this post