তহবিল ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছেন পুনর্গঠিত ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকগুলোতে যে হারে আমানত আসছে উত্তোলনের চাপ তার চেয়েও বেশি হচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিনই রেশনিং করে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলম, নাসা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ যেসব বড় বড় ঋণ গ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তারা কোনো অর্থই পরিশোধ করছেন না। পাশাপাশি আমানতও তেমন একটা আসছে না। আর এ কারণেই প্রতিদিনই গ্রাহকদের সাথে নানা ধরনের মনোমানিল্য হচ্ছে। এ বিষয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাংকটি দখলে নেয়ার পরপরই একে একে ইসলামী ধারার আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক দখলে নেয় গ্রুপটি। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এস আলমকে দিয়ে শুধু দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকেই দখল করা হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। দখল করার পর ব্যাংকগুলো খালি করার মিশনে নামেন দেশের আর্থিক খাতের অভিশাপ সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। শুধু ৮টি ইসলামী ব্যাংক থেকেই প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বের করে নেয় মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকেই নামে বেনামে নেয়া হয় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। শুধু এস আলমই এ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়নি, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়। কিন্তু এসব অর্থ পরিশোধ না করে বছরের পর বছর নানা কৌশল অবলম্বন করে তা নিয়মিত দেখানো হয়।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকটি এস আলম দখলের আগে খুবই ভালো ব্যাংক ছিল। ব্যাংকটির আর্থিক সূচক থেকে শুরু করে বছর শেষে মুনাফা সব দিক থেকেই শীর্ষ ব্যাংকগুলোর তালিকায় ছিল। কিন্তু এস আলম দখল করার পর পানির মতো অর্থ বের করে নেয় এ ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানেজ করে কোনো প্রকার ধামাচাপা দিয়ে এতদিন জোড়াতালি দিয়ে চলছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে তহবিল ঘাটতি পূরণ করার জন্য টাকা ছাপিয়ে অর্থের জোগান দেয়া হতো। ফলে বোঝা যেত না ব্যাংকটির প্রকৃত অবস্থা। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বিদায় নেয়ার পর থেকে ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র বের হতে থাকে। অন্তবর্তীকালীন সরকার এস আলমকে বিদায় করে দিয়ে ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে। এরপর থেকেই ব্যাংকটির আসল চিত্র বের হতে থাকে। এখন ব্যাংকটিতে চরম অস্থিরতা চলছে। প্রতিটি শাখায় চলছে এ অরজকতা। গ্রাহকরা যে পরিমাণ টাকা উত্তোলনের জন্য পে-অর্ডার দিচ্ছে ওই পরিমাণ আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
তারা ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করছেন। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল জোগান দেয়ায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে আবারো বিভিন্ন সেবামূলক বিল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ শুরু হয়েছে। ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ফোরকানউল্লাহ বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এখন কিছুটা ডিপোজিট পাওয়া যাচ্ছে। ঋণ আদায়েরও চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার বিল নেয়া শুরু হয়েছে। আশা করছি, বিদ্যমান সমস্যা দ্রুতই কেটে যাবে।
এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেড় দশক ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ দখল করে রেখেছিল নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি নিজে যেমন ব্যাংকটি থেকে নামে বেনামে ঋণ নিয়েছেন, তেমনি যোগসাজশের মাধ্যমে অন্য গ্রুপকে দিয়েও এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে সহায়তা করেছেন। এর মধ্যে শিকদার গ্রুপেরই বকেয়া ঋণের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর বাইরে এস আলম, বেক্সিমসহ আরো কয়েকটি গ্রুপকে জোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়েছিল। এসব ঋণ আদায়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে, আমানত ও ঋণ আদায়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ তহবিল সংস্থান হচ্ছে, উত্তোলনের চাপ তার চেয়েও বেশি। এ কারণে রেশনিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের চাহিদা সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে, এস আলমের দখলকৃত ব্যাংকগুলোর চেয়ে এ ব্যাংকের অবস্থান কিছুটা ভালো বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তবে, ব্যাংকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফার্র্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক নাজুক অবস্থানে রয়েছে। এসব ব্যাংক থেকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তেমন অর্থ দিতে পারছেন না শাখা ব্যবস্থাপকরা।
ব্যতিক্রম ইসলামী ব্যাংকের। এ ব্যাংকটি থেকে এস আলম সবচেয়ে বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে। কিন্তু এর পরেও ব্যাংকটির নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারা নানাভাবে ব্যাংকটিকে গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। এস আলম ঝড়ে লন্ডভন্ড হওয়া ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা দ্রুত পরিবর্তনের চেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ কষ্ট ছিল এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। মাসখানেকের মধ্যে পুরোপুরিই ব্যাংকটি সাবেক অবস্থানে ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারাও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। শিকদার গ্রুপ যে পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছে তা দ্রুত আদায় করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে আল আরাফা ব্যাংকের অবস্থা আগে থেকেই ভালো ছিল। এ ব্যাংক থেকে এস আলম তেমন অর্থ বের করে নিতে পারেনি শক্ত পর্ষদ থাকার কারণে। যদিও দীর্ঘ দিন যাবত এস আলমের ভাই আব্দুস সামাদ লাবু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার পর আমানত প্রত্যাহারের চাপ কিছুটা বেড়েছে। এটা সহসাই কেটে যাবে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
Discussion about this post